৪ বছর ধরে ‘হোম অফিস’ করেন ইউপি চেয়ারম্যান ছিদ্দিক আলী!

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদবিচ্ছিন্ন সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছিদ্দিক আলী মণ্ডল। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গত চার বছরে এক দিনের জন্যও পা রাখেননি পরিষদ ভবনে। পরিষদ থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে চেয়ারম্যান তাঁর বাড়িতে বসে কার্যক্রম চালান।

স্থানীয়রা জানায়, চেয়ারম্যান না যাওয়ায় সচিব, সংরক্ষিত নারীসহ সাধারণ সদস্যরাও পরিষদে যান না। সরকারি নিয়ম অনুসারে পরিষদে ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্র, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সেবাকর্মীর দপ্তর থাকার কথা। যাতে করে সাধারণ মানুষ সহজে সরকারি সেবা ভোগ করতে পারে। বাস্তবে এসব কার্যক্রমের কোনো ছিটেফোঁটা খুঁজে পাওয়া যায়নি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে।

সরেজমিন ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনে কেউ যাতায়াত করে না। দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করা হয় ২০০২ সালে। নির্মাণের পর চেয়ারম্যান পরিষদে বসলেও গত ২০১০ সাল থেকে ক্রমে এটি ভূতুড়ে হয়ে পড়েছে। এর আগে ১৯৮৭ সালে সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদ স্থাপিত হওয়ার পরের বছরে ইউনিয়ন পরিষদে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল আউয়াল। এরপর ১৯৯২ সালে মনোয়ারা বেগম, ১৯৯৭ সালে লুৎফা বেগম, ২০০২ সালে মো. শাহাজামাল, ২০১০ সালে আব্দুল বাতেন এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সিদ্দিক আলী মণ্ডল চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন।

ঘুরে ঘুরে দেখা মিলল ভবনের বিভিন্ন অংশে ডজনখানেক মৌমাছির চাক। কোথাও ইউনিয়ন পরিষদের নাম লেখা নেই। কক্ষের দরজা ভাঙা, জানালাগুলো খোলা। এলোমেলো থাকা চেয়ার-টেবিলে এক ইঞ্চি পুরু বালুর আস্তরণ। বালুতে ঢেকে গেছে চেয়ারম্যানের কক্ষে টানানো থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। ইউপি সচিবের কক্ষে প্রয়োজনী কাগজপত্র মাকড়সার জালে ঢেকে আছে। বারান্দা ও মাঠে ময়লার স্তূপ। ভবনের কক্ষগুলোতে যে মাদকসেবীদের নিরাপদ আড্ডাখানা তা বোঝা গেল।

চরের বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, ‘চেয়ারম্যান যদি বাড়িতে বসে অফিস করেন, তাহলে সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করছে কেন? আমি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।’

চরের মানুষরা জানায়, চেয়ারম্যানের বাড়িতে পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয় করা হয়েছে। সেখানে সচিব ও সদস্যরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। অস্থায়ী এই কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি যেতে দুটি খেয়া পার হতে হয়।

চরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘চারিত্রিক, নাগরিক, প্রত্যয়নপত্র ও জন্ম নিবন্ধনের কাজ করতে হলে দেড় শ টাকা খরচ করে চেয়ারম্যানের বাড়িতে যেতে হয়। আমার মতো চরের সব মানুষের একই সমস্যা, দুর্ভোগও।’

পারভীন বেগম বলেন, ‘ভিজিডির চালসহ সরকারের সব সাহায্য-সহযোগিতা চেয়ারম্যানের বাড়ি থিকা নিতে হয় আমগর।’

ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নুর ইসলাম বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে বসা হয় না, কথাটি সত্য। কিন্তু আমাদের কার্যক্রম তো আর বন্ধ না। চেয়ারম্যানের বাড়িতে অস্থায়ী অফিস করেছি। সেখান থেকে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে।’

ওয়ার্ড সদস্য তাহেজ আলী ও শাহজাহান আলী জানান, প্রায় ২০ হাজারের মতো জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউনিয়নের সীমানা ব্রহ্মপুত্র নদ দুই ভাগে ভাগ করেছে। একপাশে সাহেবের আলগা, গেন্দার আলগা, নামাজের চর ও দক্ষিণ নামাজের চর। অন্য পাশে জাহাজের আলগা। ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স থেকে কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ার কারণে চরের মানুষের দুর্ভোগ নিত্যদিনের।

গেন্দার আলগা চরের বাসিন্দা, কল্পনা খাতুন, আব্দুল আলীম, মিলন মিয়া, নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ার কারণে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার বেশির ভাগই চেয়ারম্যান আত্মসাৎ করেন।

৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য সনেকা খাতুন অভিযোগ করেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সরকারি সব কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। কেন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে তা করা হবে?’

সাহেবের আলগা ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মণ্ডল বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন অনেক দূরে। তাই সেখানে বসা হয় না। পরিষদের কার্যক্রম এবং সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা আমার বাড়ি থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আমি কোনো অন্যায়-দুর্নীতি করেছি কি না, সেটা খুঁজে দেখেন।’

উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরে জান্নাত রুমি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনে সরকারি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা হয় না—এমন তথ্য আমার জানা নেই। আমি অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’