জেনে নিন, প্ল্যাজারিজম কি এবং কীভাবে এড়াবেন?

যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাজুয়েট স্কুলে গবেষণা করতে গেলে সবাইকে একটা প্রিলিমিনারি কোর্স পড়তে হয়। এটাকে ‌\’কোলাবরেটিভ ইনস্টিটিউশনাল ট্রেইনিং ইনিশিয়েটিভ\’ কিংবা সংক্ষেপে \’সিআইটিআই প্রোগ্রাম\’ বলে। এই প্রোগ্রামের প্রথম চ্যাপ্টারটাই হচ্ছে প্ল্যাজারিজম। এই চ্যাপ্টারে একটা কেস স্টাডি পড়েছিলাম।

সেটি এ রকম:

ধরুন, আপনি কোনো সেমিনারে গিয়ে কোনো একজন বক্তার বক্তব্য শুনছেন। অথবা কফি শপে বসে কয়েকজন বন্ধুর সাথে গল্প করছেন। সেমিনারে বক্তব্য শুনতে শুনতে অথবা কফি শপে গল্প করতে করতে আপনার মাথায় একটা গবেষণার আইডিয়া এলো। ওই বক্তার বক্তব্য না শুনলে কিংবা আপনার বন্ধুদের সাথে গল্প না করলে হয়তো ওই আইডিয়াটা আপনার মাথায় আসতো না। পরবর্তী সময়ে ওই আইডিয়া নিয়ে আপনি কোনো গবেষণা করলেন এবং তা প্রবন্ধ আকারে ছাপানোর জন্য কোথাও পাঠালেন। এ ক্ষেত্রে একাডেমিক সততা হচ্ছে, সেই প্রবন্ধে ওই বক্তা কিংবা আপনার বন্ধুকে ক্রেডিট দেওয়া। হতে পারে ওই গবেষণায় কিংবা প্রবন্ধ লেখার কাজে তাদের বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু যার কথা শুনে আইডিয়াটা আপনার মনের জাগ্রত হয়েছে তাকে ক্রেডিট দেওয়াটা একাডেমিক সততা। আর যদি ক্রেডিট না দেন তাহলে আপনি \’প্ল্যাজারিজম\’ করলেন। অর্থাৎ আইডিয়া চুরি করলেন যেটা হয়তো কেউ জানলোও না।

পশ্চিমা দেশগুলোতে প্ল্যাজারিজম একটি মারাত্মক অপরাধ। শিক্ষার্থীরা প্ল্যাজারিজম করলে তার ভর্তি বাতিল হওয়াসহ তাকে নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়। আর শিক্ষকদের মধ্যে কেউ করে থাকলে তার চাকরি চলে যাওয়ার মতো শাস্তির বিধান রয়েছে। এবার আসা যাক প্লেজারিজম কি সে সম্পর্কে।

প্ল্যাজারিজম
সহজ কথায় প্ল্যাজারিজম হচ্ছে, অপরের আইডিয়া, রচনা কিংবা লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া। শুধু একাডেমিক পরিমণ্ডল নয়, সাংবাদিকতায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে এরকম উদাহরণ অহরহ। কোনো সংবাদ সংস্থার সংবাদ একটু এদিক ওদিক করে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া কিংবা আরেকজনের তোলা ফুটেজ জোড়াতালি দিয়ে কিংবা এডিটিং প্যানেলে একটু পরিবর্তন নিয়ে এসে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া খুবই সহজ। আজকাল কোনো ঘটনার উপর গুগলে ইমেজ সার্চ করলেই অনেক ধরণের ছবি পাওয়া যায়। সেখান থেকে কোনো ছবি নিয়ে একটু এডিট করে পত্রিকায় ছাপানো কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করাও প্ল্যাজারিজম।

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়া তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা গবেষণা নির্দেশনায় প্ল্যাজারিজমকে মোটাদাগে পাচঁভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো, সম্পূর্ণ প্ল্যাজারিজম, প্রায় সম্পূর্ণ প্ল্যাজারিজম, জোড়াতালি প্ল্যাজারিজম, অলস প্ল্যাজারিজম এবং স্ব-প্ল্যাজারিজম (গর্ডন এবং উয়াইন, ২০১৭)।

\’সম্পূর্ণ প্ল্যাজারিজম\’ হচ্ছে, কারো রচনা কিংবা লেখা হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া। লেখাটি প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত হতে পারে। একজনের অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা লেখা অন্যজন যদি সরাসরি নিজের নামে চালিয়ে দেয় তাহলে তা সম্পূর্ণ প্ল্যাজারিজমের আওতায় পড়বে। বিদেশি সংবাদ সংস্থা থেকে নেওয়া কোনো সংবাদ অনুবাদ করে তাদেরকে ক্রেডিট না দিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়াটাও প্ল্যাজারিজম। এক্ষেত্রে শুধু লেখাটাকে নিজের মতো করে লেখা কিংবা যার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে তার ক্রেডিট দিলেই লেখক প্ল্যাজারিজমের দায় এড়াতে পারেন না।

\’প্রায়-সম্পূর্ণ প্ল্যাজারিজম\’ হচ্ছে শুধু ভূমিকা আর উপসংহার নিজের মতো করে লিখে মূল অংশটা কারো লেখা থেকে কপি করা। অথবা কোনো লেখকের পুরো লেখার মাঝখানে নিজের চিন্তা ভাবনা লিখে দেওয়াটাও এই ধরণের প্ল্যাজারিজমের মধ্যে পড়ে। এই ধরণের চর্চা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ লেখার অধিকাংশই লেখকের নিজের না।

অনেকেই বিভিন্ন লেখকের কাছ থেকে অনেক ধরনের লেখা জোড়াতালি দিয়ে একটা লেখা তৈরি করে এবং সেটাকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। এ রকম লেখার কোন অংশটা লেখকের নিজের এবং কোন অংশটা অন্যের কাছ থেকে ধার করে লেখা তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে এ ধরণের লেখাও প্ল্যাজারিজমের আওতাধীন।

নিজের অন্য কোনো লেখা থেকে রেফারেন্স ছাড়া কপি করাটাও প্ল্যাজারিজমের মধ্যে পড়ে। ধরুন, আমি একটা বই লিখলাম। পরবর্তীতে অন্য কোনো প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে যদি ওই বই থেকে কোনো ধরণের সাইটেশন ছাড়া তিন শব্দের বেশি হুবহু কপি করি তাহলেও তা স্ব-প্ল্যাজারিজমের আওতায় পড়বে। তাই নিজের লেখা থেকে কপি করার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে।

কীভাবে প্ল্যাজারিজম এড়াবেন?
গবেষণা প্রবন্ধে নিজের চিন্তাকে সমর্থন করার জন্য অন্যের লেখা কিংবা আইডিয়া থেকে কিছু নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর যখনই অন্যের লেখা থেকে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে তখনই প্ল্যাজারিজমের ব্যাপারটা চলে আসে। তবে ঠিক কত শতাংশ লেখা অন্যের কাছ থেকে সাইট করা যাবে তার কোনো সঠিক মাপকাঠি নাই। তবে এই হার ২০ শতাংশের বেশি না হওয়াই ভালো।

আমেরিকাতে শিক্ষার্থীদেরকে প্ল্যাজারিজম এড়ানোর জন্য বেশকিছু কৌশল বাতলে দেয়া হয় ।

নিজের মতো করে লেখা: বাইরের দেশে কারো লেখা ধার করলেও তা সরাসরি কপি না করে নিজের মতো করে লিখতে পরামর্শ দেয়া হয়। আর এতে লেখকের লেখার যে গতিময়তা তা রক্ষা হয় এবং প্ল্যাজারিজমের হাত থেকে বাঁচতে পারেন। এখানে লক্ষণীয় যে, কারো লেখা নিজের মতো করে নিজের ভাষায় লিখলেও তা সাইট করতে হবে। আর সাইট না করলে তা প্ল্যাজারিজম হবে।

সাইট করা: শুধু একাডেমিক কাজ না, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও কারো লেখা কপি করতে হলে তা সাইট করতে হবে। সাংবাদিকরা একটা কাজ প্রায়ই করে থাকেন। আর তা হচ্ছে গুগল থেকে ছবি ডাউনলোড করে নিজের সম্পত্তি মনে করে তা পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন। কিন্তু একবারের জন্যও ভাবেন না ডাউনলোড করা ছবিটি কেউ না কেউ তুলেছে। এক্ষেত্রেও সাইটেশন দিতে হবে না হয় তা প্ল্যাজারিজমের আওতায় পড়বে।

উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার: যদি কেউ কোনো লেখকের কাছ থেকে সরাসরি তিন শব্দের বেশি কপি করে তাহলে তা উদ্ধৃত চিহ্নের ভিতরে রাখতে হবে। আর ৪০ শব্দের কম কপি করলে তাও উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরে রাখতে হবে। আর কপির পরিমাণ যদি ৪০ শব্দের বেশি হয় সেক্ষেত্রে তা আলাদা প্যারা আকারে উল্লেখ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই তা প্ল্যাজারিজম হবে।

নিজের লেখা সাইট করা: নিজের আগের কোনো লেখা হলেও তা পরের লেখায় হুবহু কপি করলে তাও প্ল্যাজারিজমের আওয়ায় পড়বে। সেক্ষেত্রে প্ল্যাজারিজম এড়ানোর জন্য নিজের আগের কোনো লেখা থেকে কোনোকিছু নিলেও তা সাইট করতে হবে। এক্ষেত্রে লেখকেরই লাভ। কারণ একাডেময়িাতে একজন লেখকের কোনো আর্টিকেল থেকে কতবার সাইট করা হয়েছে এটাও গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক রেফারেন্সিং: রেফারেন্সিং এর বিভিন্ন ধরণের স্টাইল চালু আছে। সেগুলো হচ্ছে এপিএ, এমএলএ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এবং শিকাগো। এক এক জার্নাল এক এক ধরণের স্টাইল অনুসরণ করে। আর লেখাটি যে জার্নালে ছাপানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে সেই জার্নালের নির্দিষ্ট স্টাইলও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের স্টাইল অনুসরণ করা উচিত।

তথ্যসূত্র:
গর্ডন, সি. এইচ., এবং উয়াইন, জি. (২০১৭, জুন ২৬)। প্ল্যাজারিজম – হোয়াট ইট ইজ অ্যান্ড হাউ টু এভয়ড ইট। রিসার্চ গাইডস। নেয়া হয়েছে সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭, http://gethelp.library.upenn.edu/guides/engineering/ee/plagiarize.html

লেখক: প্রতিষ্ঠান ও প্রধান নির্বাহী, বিডি ফ্যাক্ট চেক

বাংলাদেশ সময় : ১৩৩৬ ঘণ্টা, ০১ অক্টোবর,  ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/ডিএ