‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতিতে এগোচ্ছে চীন!

চীন তার বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য সবসময় সমালোচনায় থাকছে। দক্ষিণ চীন সাগরে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করছে বেইজিং। ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের দাবিকে পাত্তা না দিয়েই এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই রাষ্ট্রটি অনেক বিতর্কিত অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করছে। দক্ষিণ চীন সাগরীয় অঞ্চলে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি চালু করছে চীনের কমিউনিস্ট সরকার। আর বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দ্বিগুণ প্রচরাণা চালাচ্ছে দেশটি। এমনটাই দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিসি ফর ইস্ট এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড আর স্টিলওয়েল।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় এই বিষয়টি তুলে ধরেন ডেভিড আর স্টিলওয়েল। তিনি জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্ব যখন কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়ছে; তখন দক্ষিণ চীন সাগরে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করছে বেইজিং। অন্য উপকূলীয় দেশগুলোর সার্বভৌম অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় সম্পদের মালিকানা থেকে তাদের বঞ্চিত করছে দেশটি। কিন্তু ওই সম্পদের মালিকানা চীনের নয়, উপকূলীয় দেশগুলোর।

সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরের বেশির ভাগের ওপর চীনের একচ্ছত্র মালিকানার দাবি দ্য হেগের মীমাংসা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বেইজিংয়ের নাইন-ড্যাশ লাইনের সমুদ্রসংশ্লিষ্ট দাবির আন্তর্জাতিক আইনে কোনো ভিত্তি নেই।

দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে আলোচনার সময় চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করেছেন ডেভিড আর স্টিলওয়েল। চারটি দিক হলো, বেইজিংয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত এন্টারপ্রাইজেসের (এসওই) ভূমিকা; আচরণবিধি নিয়ে চীন ও আসিয়ানের মধ্যে আলোচনা; দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সম্পদের যৌথ উন্নয়নে বেইজিংয়ের চাপ এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি বা আইটিএলওএস-এ বিচারকের একটি আসনের জন্য প্রচারণা।

তিনি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে, অন্য কোথাও অর্থনৈতিক জুলুম বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজগুলোকে ব্যবহার করেছে বেইজিং। দক্ষিণ চীন সাগরের স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের এলাকায় কৃত্রিম দ্বীপগুলোতে ড্রেজিং, স্থাপনা নির্মাণ এবং সামরিকীকরণের জন্য এন্টারপ্রাইজগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে বেইজিং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

বেইজিংয়ের শীর্ষস্থানীয় অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস করপোরেশন (সিসিসিসি) বিশ্বজুড়েই কাজ করে। দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সামরিক ঘাঁটিগুলোর নির্মাণকাজে ড্রেজিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এতে সামুদ্রিক পরিবেশে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে বলে দাবি ডেভিড আর স্টিলওয়েলের।

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জলরাশিতে বাণিজ্যিক জরিপের কাজে বেশ কয়েকটি জাহাজ পাঠিয়েছে বেইজিং। এটি করার কোনো অধিকার নেই তাদের। বেইজিংয়ের বেআইনি দাবি ও তর্জন-গর্জন আরো জোরদার করতে অসংখ্য চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পর্যটনবিষয়ক সংস্থা, টেলিকম সংস্থা, ফিশারি এবং ব্যাংকিং সংস্থাগুলো বিনিয়োগ করে থাকে।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা মাছ ধরার নৌযানের বহরগুলো প্রায়ই সামুদ্রিক মিলিশিয়া হিসেবে কাজ করে দেশটির সামরিক বাহিনীর নির্দেশনায়। রাষ্টীয় বল প্রয়োগের কৌশল হিসেবে মিলিশিয়াগুলো অন্যদের হয়রানি করে এবং ভয় দেখায়। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজগুলো অন্যদের হয়রানি করার অন্যতম হাতিয়ার। এমনটাই দাবি তাঁর।

আচরণবিধির আলোচনা নিয়ে ডেভিড আর স্টিলওয়েল বলেন, বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্টতই বাজে ধারণা রয়েছে। কয়েক বছর ধরে বেইজিং জোর দিয়ে আসছিল যে, হয়তো আসিয়ান দেশগুলো এই প্রক্রিয়াটিতে নীরব থাকবে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে- কেন বন্ধ দরজার পেছনে চীন আসিয়ান দেশগুলোকে জাতীয় স্বার্থের মূল বিষয়গুলোর ওপর সীমাবদ্ধতা রাখতে চাপ দিয়েছে।

তিনি বলেন, আসিয়ানের কোন দেশগুলো চীনের সঙ্গে সামরিক মহড়া এবং উপকূলের তেল ও গ্যাস উত্তোলনের কাজ করতে পারবে, সে ব্যাপারেও সীমাবদ্ধতা দিয়ে রেখেছে চীন। বেইজিং আশিয়ান দেশগুলোকে ‘বাইরের’ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে এবং আন্তর্জাতিক আইনের বুলি কম আওরাতে চাপ দিচ্ছে।

তার দাবি, এগুলো আসলে তর্জন-গর্জনের লক্ষণ, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর লক্ষণ নয়। ২০২১ সালের মধ্যে আচরণবিধি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি চীন সমর্থন করে থাকতে পারে কিন্তু এর মধ্যে আধিপত্যবাদী লক্ষ্য রয়েছে।

‘যৌথ উন্নয়ন’ চুক্তি নিয়ে বক্তব্যে স্টিলওয়েল বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরের তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর আধিপত্য ধরে রাখতে চায় চীন। এ বিষয়টিতে সফল হতে চায় দেশটি। ‘যৌথ উন্নয়ন’ চুক্তি ছাড়া ওই অঞ্চলের তেল ও গ্যাস সম্পদের মালিকানা অস্বীকার করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে বেইজিং। এতে ছোট দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে যেগুলো চীনপন্থী নয়।

‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি’ বা আইটিএলওএস-এর বিচারকের একটি আসন পাওয়া নিয়েও কাজ করছে চীন। বিষয়টি নিয়ে ডেভিড আর স্টিলওয়েল বলেন, আগস্টের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আইটিএলওএসের নির্বাচনে বিচারক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন প্রার্থী দিচ্ছে চীন।

আসন্ন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে চীনা প্রার্থীর প্রশংসাপত্র যত্ন সহকারে মূল্যায়ন করার জন্য আহ্বান জানান ডেভিড আর স্টিলওয়েল।
সূত্র : এএনআই।