যে কারণে ফের ক্ষমতায় তৃণমূল

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ১৪৮টি আসনের। তবে তৃণমূল ২১০টিরও বেশি আসন পেয়েছে।

গতকাল রোববার (২ মে) স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯২টি আসনের আট দফার নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়। এরপর একে একে ঘোষণা করা হয় ফলাফল।

তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেও প্রতিকূলতা নেহাত কম ছিল না। কি কি কারণে আবার জয় পেয়েছে তৃণমূল তার কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হলো-

দুয়ারে সরকার কর্মসূচি : দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদের শেষের দিকে এই কর্মসূচি চালু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ নিয়ে বিরোধী শিবিরে বিস্তর কটাক্ষ থাকলেও জনমানসে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা ভোটবাক্সে বোঝা গেছে।

বিজেপিবিরোধী ভোট এককাট্টা হওয়া : পশ্চিমবঙ্গে ভোটের লড়াইটা যে বিজেপি বনাম তৃণমূল হবে, তা আগে থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন ভোটাররা। সেই সঙ্গে বিজেপিকে রুখতে পারবে একমাত্র তৃণমূল এমন ভাবনাও কাজ করেছে ভোটারদের মনে। তার ফলে বিজেপিবিরোধী ভোটের বেশির ভাগটাই তৃণমূলের ভোট ব্যাংকে গেছে। সেই প্রমাণ মিলেছে তৃণমূলের ভোটের হার বৃদ্ধি পাওয়ায়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ : যত শেষের দিকে এগিয়েছে ভোট, তত তৃণমূলের দাপট বেড়েছে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে- সেই সময় দেশে করোনার প্রকোপ তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে মোদি সরকারকে দোষে প্রচার চালিয়েছে তৃণমূল, যা ভোটব্যাংকে প্রভাব ফেলেছে।

মমতার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা : প্রথম থেকেই মমতা বলে এসেছেন, ২৯৪টি আসনেই প্রার্থী তিনি। নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন। যথারীতি সেই প্রয়াস কাজে দিয়েছে।

এদিকে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের জন্য ১৪৮টি আসন প্রয়োজন থাকলেও মমতার দল জয় পায় ২১০টির বেশি আসন। অন্যদিকে বিরোধী দল বিজেপি পায় ৭৫টির বেশি আসন। তবে ভরাডুবি হয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের।

ভোট গণনার দিন, শুরু থেকেই নানা ধরনের নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় আলোচিত নন্দিগ্রাম আসনে। কখনো এগিয়ে থাকেন মমতা আবার কখনো বা বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। তবে রোববার সন্ধ্যার পর বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দুকে জয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এর কিছু পরই আবার স্থগিত করা হয় ফলাফল। তবে নানা জল্পনা-কল্পনার পর শুভেন্দুকেই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

রাজ্যটিতে গত ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট দফায় ভোট হয় ২৯২টি আসনে। করোনায় দুজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় দুটি আসনে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।

অন্যদিকে, ৩৪ বছর শাসন করে ২০১১ সালের পর গত এক দশকে কোনও রকম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও একুশের ঝড়ে একেবারেই নিশ্চিহ্ন বামফ্রন্ট-কংগ্রেস। আর ক্ষমতায় যাওয়ার গভীর আত্মবিশ্বাস দেখালেও শেষ পর্যন্ত বিরোধী আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বিজেপিকে। পরাজয়ের কারণ খুঁজতে গেরুয়া শিবিরে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ সাহায্য নিয়ে আর্থিক দুর্নীতি, কোভিড অব্যবস্থাপনা, সরকারি প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ, সারদা, নারদার মতো কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের বিরুদ্ধে বিজেপির বড় অস্ত্র। এ ছাড়াও প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণের মতো রাজনৈতিক হাতিয়ারও ছিল বিজেপির বড় চমক।

তবে বিজেপির সব অস্ত্রকে ভোঁতা করে নির্বাচনে বাজিমাত করেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার মানুষের মনের মতো কিছু প্রকল্পের কারণে পেয়েছেন সাধারণের ব্যাপক সমর্থন। এর মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথীর মতো কিছু প্রকল্প। এছাড়াও নির্বাচনের আগে বাংলা তার নিজের মেয়েকে চায়- এই স্লোগান তুলে মমতা দল যে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেও ছিল পশ্চিমবঙ্গের নারীদের বাড়তি সমর্থন।

আর ২০১১ সালে গো-হারা হয়ে বামফ্রন্ট সমর্থকরা মমতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিয়েছেন। সেই বামফ্রন্ট এবার হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে আটকাতেই ঢালাওভাবে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার ফলেও তৃণমূলের কাছে এ জয়ের রাস্তা তৈরি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। যদিও এবার তারা বিধানসভার একটি আসনও না পেয়ে রাজনৈতিকভাবে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।