ইউক্রেনে আটকে থাকা খাদ্যশস্য কেন বিশ্বের দরকার?

ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে পণ্যবাহী কার্গোর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্প্রতি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায়। যদিও চুক্তি সই হওয়ার পরদিনই বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেছে ইউক্রেনের বৃহৎ একটি বন্দর।

বন্দর শহর ওডেসাতে চালানো এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বড় ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে হওয়া এই সমঝোতার ভবিষ্যৎ নিয়ে।

এসব বন্দরগুলোর ওপর রাশিয়ার অবরোধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছিলো এবং দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছিলো।

ইউক্রেনে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য আটকে আছে?

ইউক্রেনে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত থাকা প্রায় বিশ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য আটকা পড়ে আছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন চলতি বছরের ফসল তোলার পর এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৫ মিলিয়ন টন।

দেশটি বছরে প্রায় ৮৬ মিলিয়ন টনের মতো খাদ্যশস্য উৎপাদন করে যার ত্রিশ ভাগ তোলাই হয় না বলে জানিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লরা ওয়েলেসলি। এবার যুদ্ধের কারণে ফসল তোলার পরিমাণ আরও কম হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

কোথায় যায় ইউক্রেনের গম?

মিশর ইউক্রেনের গমের বড় ক্রেতা। দেশটি ৩৬ লাখ টনের বেশি আমদানি করে ইউক্রেন থেকে।

দ্বিতীয় বড় ক্রেতা হলো ইন্দোনেশিয়া যারা বছরে ৩২ লাখ টন গম আমদানি করে। আর তৃতীয় বড় ক্রেতা দেশ হলো বাংলাদেশ, যার আমদানির পরিমাণ হলো ২৩ লাখ টন।

এর বাইরে দশ লাখ টনের সামান্য বেশি পরিমাণ করে আমদানি করে তুরস্ক, ইয়েমেন ও ফিলিপাইন। এছাড়া মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইথিওপিয়া ইউক্রেন থেকে গম নিয়ে থাকে।

বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে শস্য ঘাটতি যেভাবে প্রভাব ফেলেছে

ইউক্রেন বিশ্বের চতুর্থ খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের ৪২ ভাগ সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয় এই দেশটিতে। এছাড়া মোট ভুট্টার ১৬ ভাগ ও ৯ ভাগ গম তারাই উৎপাদন করে।

এর বাইরে বিশ্বে গমের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক রাশিয়া থেকে রপ্তানি কমে গেছে এই যুদ্ধের জের ধরে।

যদিও রাশিয়ার কৃষির ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমারা দেয়নি, কিন্তু পেমেন্ট সিস্টেমে প্রভাব পড়ার পাশাপাশি ইন্স্যুরেন্স ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে রাশিয়ার রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।

রাশিয়ার কৃষিপণ্যবাহী জাহাজগুলোকেও অবশ্য ইউরোপের বন্দরগুলোতে এখনো কোন বাধা দেয়া হচ্ছেনা। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে আফ্রিকার প্রয়োজনীয় গমের ৪০ ভাগই সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।

কিন্তু যুদ্ধের কারণে প্রায় তিন কোটি টন খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে আফ্রিকায়। যার ফলে পুরো মহাদেশজুড়ে খাদ্যের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। নাইজেরিয়ায় পাস্তা ও ব্রেডের দাম বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ। একইভাবে ইয়েমেন প্রতিবছর দশ লাখ টনেরও বেশি গম আমদানি করে ইউক্রেন থেকে।

ওডেসা বন্দরের কাছে এরকম বিভিন্ন গুদামে রপ্তানির জন্য দুই কোটি টন খাদ্যশস্য রয়েছে

জাতিসংঘ জানিয়েছে সরবরাহ না থাকায় জানুয়ারি থেকে মে সময়কালে ময়দার দাম বেড়েছে ৪২ ভাগ আর ব্রেডের ২৫ ভাগ।

সিরিয়া ইউক্রেনের গমের আরেক বড় ক্রেতা দেশ। সেখানে ব্রেডের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

তবে সর্বশেষ যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো সেই খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে।

যদিও লরা ওয়েলেসলি বলছেন যে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য পর্যাপ্ত পরিমাণে জাহাজীকরণ না হল মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশেই সংকট দেখা দেবে।

নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পরিকল্পনা কী

কৃষ্ণসাগরে সামুদ্রিক করিডোর উন্মুক্ত করতে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় চুক্তি করেছে ইউক্রেন ও রাশিয়া।

কর্মকর্তারা বলছেন এ পরিকল্পনায় আছে:

•যেসব বন্দরে মাইন পোতা আছে সেখানে শস্যবাহী জাহাজগুলোকে গাইড করে নিয়ে যাবে ইউক্রেনের জলযান

•পণ্য জাহাজীকরণের সময় যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে রাশিয়া

•জাহাজে অস্ত্র আনার বিষয়ে রাশিয়ার উদ্বেগের কারণে এটি পর্যবেক্ষণ করবে তুরস্ক

•কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়া শস্য ও সার রপ্তানি করতে পারবে

ইউক্রেনের রাশিয়ার হামলার পর থেকেই কৃষ্ণসাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ইন্স্যুরেন্স খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

তবে এখন ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান লয়েডস মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন বলছে যে চুক্তির কারণে এ খরচ কমে আসা উচিত।

নিরাপদ সাগর করিডোর ছাড়া কীভাবে রপ্তানি হচ্ছিলো

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন তার ৯০ শতাংশ শস্য রপ্তানি করতো সাগর পথেই। কিন্তু বন্দরগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় দেশটি ট্রাক ও ট্রেনযোগে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করে।

আবার বাল্টিক সাগর দিয়ে যাতে ইউক্রেনের পণ্য যেতে পারে সেজন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় ইউরোপ।

তবে সমস্যা হলো ইউক্রেনের ট্রেন লাইনগুলো ইউরোপের চেয়ে চওড়া। এর ফলে একবার পণ্য লোড করে ওয়াগনগুলো সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে আবার পরিবর্তন করতে হতো।

এর ফলে ইউরোপ পাড়ি গিয়ে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত যেতেই তিন সপ্তাহ সময় লেগে যাচ্ছিলো।

ইউক্রেনের গ্রেইন অ্যাসোসিয়েশনের মতে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানির পরিমাণ কমে এখন পনের লাখ টনের মতো, যা যুদ্ধের আগে ছিলো ৭০ লাখ টন।

সংবাদ সূত্রঃ বিবিসি বাংলা