বিপদে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

মাস অতিক্রম হয়ে গেল রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যৌক্তিক কোনো সমঝোতায় আসতে পারল না। ইতোমধ্যে চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত ডিঙিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ পড়েছে শরণার্থী ঢলের চাপে।

এ অবস্থায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচআরের হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শন শেষে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সীমান্তের ওপারে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম চাপের মুখে আছে। তারা স্থানচ্যুত হয়েছে। সহিংসতা বন্ধ না হলে আবারো তারা দলে দলে আসবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কোথাও এত দ্রæততার সাথে শরণার্থী সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠেনি। তার মতে, এ মুহূর্তে মিয়ানমারের উচিত সহিংসতা বন্ধ করা। একই সাথে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া।’

ফিলিপো গ্রান্ডির আশঙ্কার সত্য প্রমাণ হয়েছে। এক দিনের মধ্যে নতুন করে সাত হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আসার কারণ হত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তাদের আর পালিয়ে থাকার কোনো অবস্থা ছিল না।

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে যে জাতিগত নিধন শুরু করে তাতে মংডু শহরাঞ্চলের বাসিন্দারা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু নতুন করে আসা শরণার্থীদের প্রায় সবাই মংডুর বাসিন্দা। এতে বোঝা যায়, রাখাইনের অবস্থা দিনকে দিন কোন দিকে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি।

ওই ভাষণে রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সু চি বলেছিলেন, কেন রাখাইন রাজ্য থেকে মানুষ চলে যাচ্ছে সেটা তিনি জানার চেষ্টা করবেন এবং সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কাজ করবেন। তার ওই টেলিভিশন বক্তব্যের আগে রাখাইনে তিনটি ক্যাম্প করে গৃহহীনদের ত্রাণ দেয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সু চি’র বক্তব্য এবং ত্রাণকার্যক্রম কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনে। কিন্তু সব কিছুই যে ভণিতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানোর কৌশল ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেলে ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করা মংডুর মংনির বাসিন্দা গুলবাহার নামে এক শরণার্থীর মুখে। তিনি বলেন, সপ্তাহখানেক আগে ত্রাণ দেয়ার একটা নাটক করে। তাদের ডেকে একটা গেঞ্জি, তিন কেজি চাল, আধা কেজি ডাল দেয়া হয়। ছবি তোলার পর ওই ত্রাণ আবার কেড়ে নেয়া হয়। মানবিক মূল্যবোধ কতটা নিচু হলে এ রকম কাজ করা যায়, সেটা বড় একটি প্রশ্ন।

এ অবস্থার মধ্যেই বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় মহাসচিব অ্যান্তোনিয়ো গুতেরেস রোহিঙ্গা সমস্যার সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরবেন। এ বৈঠক থেকে রাখাইনে দ্রুত  সহিংসতা বন্ধ করে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে পরিষদের কাছে জোরালো পদক্ষেপের আশা করা হচ্ছে। আজকের আলোচনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে রাখাইনে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করা, সেখানে বাধাহীনভাবে ত্রাণকর্মীদের কাজ করতে দেয়া এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের চাপ প্রয়োগ করা। এর আগে ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সবার আগে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে সমালোচনা করেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, মিয়ানমারে সামরিক অভিযান বন্ধে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সাথে কাজ করবেন তিনি। মিয়ানমারের সহিংসতাকে তিনি ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইউরোপের কোনো নেতার সম্ভবত এটাই সবচেয়ে কড়া সমালোচনা।

ব্রিটিশ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ ওঠায় দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিণ দেয়া স্থগিত করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের রাজতন্ত্র স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক অ্যালিস্টার কুক বলছেন, ইউরোপের অন্য দেশগুলোর উচিত যুক্তরাজ্যকে অনুসরণ করা। তিনি আরো বলেন, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রভাব এলে চীন ও রাশিয়া সেখানে ভেটো দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রভাবের পরিবর্তে ইউরোপের দেশগুলোর সমন্বিত পদপে অনেক বেশি কার্যকর হবে। এসব অবস্থানে এটা সুস্পষ্ট, মিয়ানমারের ওপর দিনকে দিন চাপ বাড়ছে। কিন্তু সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, এখন মানুষ দেখতে চায় চাপের প্রয়োগ। যা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাধ্য করতে পারে বা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের অনেক বড় নেতার মুখে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম, কানাডা রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিলেও জাতিসঙ্ঘে দেয়া ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করলেন না। তার মুখ থেকে অন্তত রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু কথা শোনার আশা করেছিলেন অনেকে। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন এই আত্মবিশ্লেষণ জরুরি যে, এই অধিবেশনের আগে বা চলার সময় আমাদের ক‚টনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট জোরালো ছিল কি? নাকি বাংলাদেশের তরফে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার সুযোগ ছিল।

ইউনাইটেড নেশনস নিউজ অ্যান্ড কমেন্ট্রি ফোরাম, ইউএন ডিসপ্যাচের এক পর্যালোচনায় জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে পাঁচটি দিকে নজর রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তাতে তিন নম্বরে ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। কিন্তু এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এ ইস্যু সেই মাত্রার গুরুত্ব পায়নি। তাই এই জায়গাটায় বাংলাদেশের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের জন্য এই চাপ সত্যিই অসহনীয়। আরাকান রাজ্যের সঙ্কটের কোনো দায় বাংলাদেশের না থাকলেও মানবিক বিবেচনায় কাজটি বাংলাদেশকে করে যেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য সবচেয়ে হতাশার কথা হচ্ছে কিছু বন্ধুদেশ বাংলাদেশের চাওয়া অনুযায়ী পাশে নেই।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার অবস্থান স্পষ্টতই মিয়ানমারের পাশে জাপান এ নিয়ে তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। তবে শরণার্থীদের সহায়তায় তারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই দেশকেই সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী এইচ ই আইওয়া হওরি ২২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সফরের সময় বলেছেন, মিয়ানমারকে সাহায্য-সহযোগিতা দেয়ার যে নীতি জাপানের আছে, তা পরিবর্তন হবে না। রাখাইন ইস্যুতে তিনি মিয়ানমারকে ১০ লাখ ডলার সহায়তার  প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। অথচ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ইস্যুতে এই দেশগুলোর সমর্থন বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা সমস্যাটির ব্যাপারে চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো সহানুভূতিশীল হলে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজটি সহজ হতো। এখানেও আবার সেই ক‚টনীতি ও এর সফলতার প্রকট চলে আসে। কারণ আশ্রিত রোহিঙ্গা ইস্যু শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয় তা বুঝাতে হবে আন্তর্জাতিক মহলকেও।

গণহত্যার শামিল এই নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার এবং রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত ও সুরক্ষিত জীবন ও নাগরিক অধিকার দিতে হবে। না হয় এই সমস্যা সামগ্রিকভবে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে। উগ্রবাদী লোকদের সাহস জোগাবে অন্যায়ের প্রতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলো অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রকট হবে। তাই এ সমস্যা অচিরেই সমাধান করতে হবে। যাতে মিয়ানমার নাগরিকরা ও তার অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুরক্ষিত থাকতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ২৯ সেপ্টেম্বর    ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসপি