সরকারে থাকবেন নাকি ভোটে নামবেন, মাহফুজ সিদ্ধান্তহীন, কোন দিকে যাবেন আসিফ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল হতে পারে আগামী সপ্তাহে। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া পদত্যাগ করে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেবেন, নাকি সরকারে থেকে যাবেন—এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। যদিও দুই উপদেষ্টার কেউ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম পদত্যাগ ও নির্বাচন করার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে গত রোববার রাতে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ঢাকা থেকে ভোট করবেন, সেটা আগেই জানিয়েছেন। তবে তিনি বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), নাকি স্বতন্ত্র—কোন পথে হাঁটবেন, সেটা এখনো খোলাসা করেননি। তাঁর রাজনৈতিক ঠিকানাও এখনো নিশ্চিত হয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সম্প্রতি আবারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। এর আগেও সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তাঁদের পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তখন তাঁরা আরও সময় চেয়েছিলেন। এরপর আরও একাধিকবার পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এর মধ্যে আসিফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, তিনি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার থেকে পদত্যাগ করতে পারেন।

তবে মাহফুজ আলমের ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো সূত্র বলছে, তিনি পদত্যাগ না করে এই সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদে থেকেও যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না। আর যদি নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে তফসিলের আগে সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন।

এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) শনিবার বলেছেন, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, অর্থাৎ আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হতে পারে।

মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তাঁদের আন্দোলনের সহকর্মীরা গত ফেব্রুয়ারিতে এনসিপি গঠন করেন।

আসিফ মাহমুদ ঢাকা-১০ আসন (ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ) থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। অন্যদিকে মাহফুজ আলম যদি নির্বাচন করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন।

ঢাকা-১০ ও লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। সেটি সরকারের এ দুই তরুণ উপদেষ্টার জন্যই কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জামায়াত এ দুই আসনেই প্রার্থী দিয়েছে।

এনসিপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটিতে মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদের প্রভাব রয়েছে। দুজনের চাওয়া ছিল, বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট করবে এনসিপি। এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কিছু আলাপ–আলোচনাও হয়েছিল। তবে এখন সেটার আর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

বরং এনসিপি তৃতীয় একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ জোটের জন্য এনসিপির সঙ্গে আলোচনায় আছে এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। যদিও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের উদ্যোগে গঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আপ বাংলাদেশকে এ জোটে রাখা নিয়ে এনসিপির দিক থেকে আপত্তি রয়েছে। আবার জোটে আসা নিয়ে গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের মধ্যেও দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এ দুটি কারণে নতুন জোট গঠনের বিষয়টি এগোচ্ছে না।

আসিফ মাহমুদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়। তিনি সেখানকার ভোটার ছিলেন। গত ৯ নভেম্বর তিনি ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনের ভোটার হওয়ার আবেদন করেন।

ওই দিন আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি ঢাকা থেকে নির্বাচন করবেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে কবে পদত্যাগ করবেন, সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

আসিফ মাহমুদ বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান বলেও আলোচনা আছে অনেক দিন ধরে। তিনি বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে, নাকি সরাসরি এনসিপি থেকে ভোট করবেন—এ নিয়ে ৯ নভেম্বর সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন। তখন আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার কথা ভাবছেন। তবে এটাও বলেছিলেন, ‘তারপর দেখা যাক।’

এর আগে ১ নভেম্বর এনসিপির সহযোগী সংগঠন জাতীয় ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানে আসিফ মাহমুদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে রাখা হয়নি। এর পর থেকে তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনসিপি ও দলটির শীর্ষ নেতাদের কারও কারও সমালোচনায় সোচ্চার দেখা যাচ্ছে।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করে দোয়া মাহফিল করেন আসিফ মাহমুদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কেরা। এর আগে গত ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আসিফের সমর্থকেরা।

ঢাকায় আসিফ মাহমুদের সম্ভাব্য নির্বাচনী আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা না করা, তাঁর সমর্থকদের মুখে এনসিপির সমালোচনা করা এবং বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হতে পারে, এমন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা—এসব বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই মনে করছেন, আসিফ মাহমুদ বিএনপি থেকে ভোট করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।

এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, আসিফ মাহমুদ বিএনপি বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে পারেন। আবার স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু এনসিপিতে তাঁর যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এদিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয় বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে জানায়, এ বিষয়ে দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি।
পদত্যাগ করে নির্বাচন করার সম্ভাবনা সম্পর্কে রোববার রাতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছেও এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখনো কিছুই জানি না।’

মাহফুজ আলম তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার (লক্ষ্মীপুর-১ আসন) ভোটার। এ আসনে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি আগে থেকেই এলাকায় সক্রিয়।

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে মাহফুজ আলম প্রার্থী হতে পারেন, এমন আলোচনা এলাকায় অনেক দিন ধরেই চলছে। তাঁর ভাই এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলমও এলাকায় সক্রিয়। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাহফুজ সরকার থেকে পদত্যাগের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। কিন্তু তিনি কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।

Scroll to Top