অপমানে কলেজছাত্রীর আত্মহত্যা

অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে প্রেমিকের পালিয়ে যাওয়া ও প্রেমিকের এলাকার লোকজন সালিসের নামে সব দায় চাপিয়ে দেওয়ায় অপমান ও হতাশায় মোমেনা নামের এক কলেজছাত্রী আত্মহত্যা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিশোরগঞ্জের রশিদাবাদ ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামে রবিবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।

মোমেনা আক্তারের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সিংরুইল ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত চান মিয়া। মেয়েটি স্থানীয় অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, অপমান ও প্ররোচনার ফলে মোমেনা আত্মহত্যা করেছে।

জানা গেছে, রবিবার সন্ধ্যায় প্রেমিক-প্রেমিকা উজ্জ্বল মিয়া ও মোমেনা আক্তারকে কিশোরগঞ্জের জামতলা বাজারে পেয়ে তাদের আটক করে কিছু লোক। ওই সময় মেয়েটি তাদের জানায়, তারা একে-অন্যকে ভালোবাসে। বিয়ে করতেই ঘর থেকে বের হয়েছে তারা। কিন্তু ছেলেটি ওই সময় তাদের সম্পর্ক অস্বীকার করে লোকজনের কাছে। এ অবস্থায় স্থানীয় ইউপি সদস্য এলাকায় এক সালিসের আয়োজন করেন।

অভিযোগ রয়েছে, সালিসকারীদের কেউ কেউ রবিবার রাতে বসানো সালিসে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ছেলেটিকে কৌশলে পালাতে সাহায্য করেন। পরদিন (সোমবার) ফের সালিসের নতুন সময় নির্ধারণ করে মেয়েটিকে এক আত্মীয়ের জিম্মায় দেওয়া হয়। এ অবস্থায় রাতে মেয়েটির ওপর পুরো ঘটনার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় নানাভাবে। সোমবার যে সালিস হবে, তাতে তাকে দোষী বানিয়ে বিচার করা হবে। এসব কারণেই গভীর রাতে মোমেনা গাছে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে।

হরিপুর গ্রামে গিয়ে জানা যায়, মোমেনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিশোরগঞ্জের রশিদাবাদ ইউনিয়নের মাকরাউন্দ গ্রামের মৃত রুস্তম আলীর ছেলে উজ্জ্বল মিয়ার (২৫)। মেয়েটির এক স্বজন জানায়, গত রবিবার সকালে মোমেনাকে মুঠোফোনে ডেকে নেন উজ্জ্বল মিয়া। বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মোমেনা ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের জামতলা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে উজ্জ্বলের সঙ্গে দেখা করে। তাদের ঘোরাঘুরি দেখে বাসস্ট্যান্ডের লোকজনের সন্দেহ হয়। তখন তাদের আটক করে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে উজ্জ্বল মেয়েটিকে নিজের ভাবি বলে পরিচয় দেন। অন্যদিকে মেয়েটি উজ্জ্বলকে প্রেমিক বলে পরিচয় দেয়। তখন উভয়ের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের খবর পাঠানো হয়।

তবে দূরত্বের কারণে কলেজছাত্রীর এলাকার লোকজন জামতলা বাসস্ট্যান্ডে সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। এর আগে রশিদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. মাহফুজ জামতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে মোমেনা ও উজ্জ্বলকে ধরে কিশোরগঞ্জ এলাকার সালামের মোড় বাজারে (রশিদাবাদ) নিয়ে যান। সেখানে সালিসের মধ্যে উজ্জ্বল সব কিছু অস্বীকার করলে তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। বাজারের দুজন ব্যবসায়ী জানান, মাহফুজ মেম্বার ও তাঁর লোকজন সালিস বসিয়ে ঘটনাটি সমাধান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ উজ্জ্বল বা তাঁর পরিবারের কেউ সালিসে উপস্থিত ছিল না।

নান্দাইলের হরিপুর গ্রামের ইউপি সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, রবিবার সন্ধ্যার পর মাহফুজ মেম্বার তাঁকে ডেকে নিয়ে মোমেনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাপাচাপি করেন। কিন্তু কোনো সমাধান ছাড়া তিনি মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যেতে রাজি হননি। সালিসে থাকা বেশ কয়েকজন জানায়, ছেলেটি মাহফুজ মেম্বারের এলাকায় হওয়ায় তিনি তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। তা ছাড়া মেয়েটি সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলছিলেন তিনি। হরিপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেন বলেন, মেম্বার মাহফুজ ছেলেটির পক্ষ নিয়ে মেয়ের আত্মীয়-স্বজনকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটিকে আজ রাতের মধ্যেই নিয়ে যান, না নিলে কাল যখন সালিস শেষে রাস্তায় উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া হবে তখন কেমন লাগবে ব্যাপারটি।

পরদিন (সোমবার) আবার নতুন সালিস বসানোর সময় নির্ধারিত থাকায় মোমেনাকে ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের আবুল হাসেমের বাড়িতে রাখা হয়। আবুল হাসেম মেয়েটিকে তাঁর জিম্মায় রাখতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে হুমকি দেন ওই মেম্বার। এ অবস্থায় এক রকম বাধ্য হয়ে তিনি মোমেনাসহ তার মামা ও ভগ্নিপতিকে বাড়িতে আতিথ্য দেন। রাত ১২টার দিকে সবার অগোচরে মেয়েটি বাড়ির পেছনে একটি মেহগনি গাছে গালায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।

এ বিষয়ে রশিদাবাদ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাহফুজুর রহমান মাহফুজ জানান, যেহেতু ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে সব সম্পর্ক অস্বীকার করেছিলেন সেই জন্য ছেলেটিকে ছেড়ে দিয়ে পরদিন (আজ সোমবার) সন্ধ্যায় আবার সালিস বসিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। এতে কী করার আছে।

ঘটনা জানতে অভিযুক্ত উজ্জ্বলের বাড়িতে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর মা অনুফা খাতুন বলেন, ‘ছেলের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি আগে কিছুই জানতেন না। এখন জেনে খারাপ লাগছে। ’ তিনি বলেন, ‘মেম্বার যদি সালিসের আগে ঘটনাটি আমাকে জানাতেন তবে মেয়েটিকে ঘরে উঠিয়ে নিতাম। এই কাজে মেম্বারের অবহেলা আছে। ’

মোমেনা আক্তারের কলেজের শিক্ষক ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, মেয়েটি অত্যন্ত মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। নিতান্তই গরিব ঘরের সন্তান হওয়ায় বিনা পয়সায় কলেজে পড়াশোনা করত। কলেজের সহপাঠীরা মোমেনার মৃত্যুর জন্য দায়ী উজ্জ্বলকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

কলেজছাত্রী মোমেনার মা শামসুন্নাহারের অভিযোগ, প্রেমিক উজ্জ্বল ও মেম্বারের কারণেই তাঁর মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সালিসে ছেলেটিকে ছেড়ে না দেওয়া হলে এ অবস্থা হতো না।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি খোন্দকার শওকত জাহানের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে আত্মহত্যার প্ররোচনার একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। তবে পুলিশ মামলার আগেই এলাকায় গিয়ে ঘটনা সম্পর্কে ধারণা নিয়েছে। মামলার পর তদন্ত করে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/পিকে