ডিমের দাম বাড়ার পিছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি

স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের অনেকটা হাতের নাগালে অন্তত ডিম ছিল। হঠাৎ করেই সেই ‘ডিম’ চলে গেছে নাগালের বাইরে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি হালি ডিমে এক লাফে বেড়েছে ১২ থেকে ১৩ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু কেন? হঠাৎ করে কেন ডিমের দামটা এত বাড়ল?

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত কিছু দিন ধরেই মুরগির খাদ্য উপকরণের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। এছাড়া করোনাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডিমের উৎপাদন আগের চেয়ে কমেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে ডিমের দামের ওপর। তবে এর সঙ্গে যুক্ত করে খামারিরা বলেছেন, ডিমের দাম বেড়েছে এটা সত্যি। কিন্তু খামারিরা কিন্তু বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেট ডিমের দাম এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি হালি ডিম ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুযোগ বুঝে পাড়া-মহল্লার কোনো কোনো দোকানে ৬০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে এক হালি ডিম। অথচ এক সপ্তাহ আগেও ৪২ থেকে ৪৪ টাকায় এক হালি ডিম পাওয়া গেছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিনের বাজারদর নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। সরকারের এ সংস্থাটি জানিয়েছে, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি হালি ফার্মের ডিমে ৩৪ দশমিক ৬২ শতাংশ দাম বেড়েছে। আর বছরের ব্যবধানে তা বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এদিকে ফার্মের মুরগির সাদা ডিম, বাদামি ডিমের তুলনায় এতদিন কিছুটা কমে বিক্রি হলেও দাম বাড়ায় তা এখন একই দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিম ৭০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে।

ডিমের পাশাপাশি ব্রয়লার, লেয়ার ও পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দামও বেড়েছে। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, লেয়ার ২৮০ টাকা ও সোনালি ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ব্রয়লার ১৬০ টাকা, লেয়ার ২৬০ টাকা ও সোনালি ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাওরান বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী রফিকুল বলেন, বাজারে মুরগির সরবরাহ কম। তাই দাম বেশি। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের পর মুরগির চাহিদা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী খামারগুলো থেকে মুরগির সরবরাহ আসছে না।

গতকাল রাজধানীর তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে কথা হয় বাজার করতে আসা রানাভোলা এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগেই স্বল্প আয়ের মানুষের প্লেট থেকে গরুর মাংস উঠে গেছে। এবার ডিমটাও উঠে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। কবির হোসেন বলেন, পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আগে বাচ্চাকে সকালে একটা ডিম খাওয়াতাম। কিন্তু এখন বোধহয় সেটা আর সম্ভব হবে না।

চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য-বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডিম উৎপাদন হয়। দেশে উৎপাদিত ডিম দিয়েই চাহিদা মেটে। পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ লাখ ডিমের চাহিদা। কিন্তু কোরবানির ঈদের পর এখন সেই চাহিদা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। কিন্তু সেই চাহিদামতো ডিমের সরবরাহ নেই।

ডিমের দাম কেন বাড়ছে? এ প্রশ্নে কাওরান বাজারের ডিমের এক আড়তদার বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, আগে যে গাড়ি ভাড়া ছিল ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তা এখন ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা। আর গাড়িতে অন্যকোনো পণ্য অতিরিক্ত পরিবহন করা যায়। কিন্তু অতিরিক্ত ডিমতো পরিবহন করার সুযোগ নেই। পরিবহনের এই বাড়তি ব্যয়তো ডিমের সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে।

পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন এ প্রসঙ্গে গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা ধাক্কা খামারিদের ভালোই লেগেছিল। সেই সঙ্গে মুরগির খাবারের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক প্রান্তিক খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে তাদের সংগঠনের যৌথভাবে করা একটি সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালে দেশে খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৬৩টি। কিন্তু এখন খামারের সংখ্যা কমতে কমতে ৭৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমে গেছে। ফলে অনেক হ্যাচারি তাদের কাছে থাকা ডিম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু এখন ডিমের চাহিদা বাড়ায় অনেক খামার চালু হয়েছে। আবার অন্যদিকে হ্যাচারিগুলোতেও ডিমের চাহিদা বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে ডিমের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে ভুট্টা আমদানি কমেছে। এতে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ১৭ টাকা কেজির ভুট্টা এখন ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। আর সয়াবিন মিলের ৩২ টাকা কেজি থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ খাতের এক জন উদ্যেক্তা বলেন, ডিমের দাম বাড়লেও খামারিরা খুব বেশি লাভবান হচ্ছেন না। কারণ, এর মধ্যে একটি সিন্ডিকেট ডিমের দাম বাড়াচ্ছে। তাদের বেঁধে দেওয়ার দামের কমে আড়তগুলোতে ডিম বিক্রি হয় না।

এদিকে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে ডিম আমদানি করা হবে। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে টিপু মুনশি বলেন, যদি এমনটাই হয় যে, সত্যি ডিম আমদানি করলে এটা কমবে, তাহলে আমরা ডিম আমদানির প্রক্রিয়ায় যাব।