নীরব ঘাতক এইডস

ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নীরব ঘাতক এইডস। এই মারণব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যার পাশাপাশি প্রতিবছরই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে; আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০০০ সালে। ওই বছর একজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর এইডসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

তথ্যমতে, গত এক বছরে (২০২৩ সাল) এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে কোনো বছর এত মানুষের মৃত্যু হয়নি। এর আগের বছর (২০২২ সাল) মারা যান ২৩২ জন। ২০২০-২১ সালে মৃত্যু ছিল ২শ’র কোঠায়। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে এইডসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

এদিকে মৃত্যুর পাশাপাশি বছর বছর রোগটিতে আক্রান্তের হারও বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে নতুন করে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ২৭৬ জনের, এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৯৪৭। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এক বছরে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর এই সংখ্যাকে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩৪ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ৯৮৪ জন। আর সাড়ে তিন দশকে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৮৬ জনের। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজুর রহমান সরকার গত বছরের প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, গত এক বছরে আক্রান্তদের মধ্যে বাংলাদেশি ১ হাজার ১১৮ জন, বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করা রোহিঙ্গা। তিনি জানান, এক বছরে আক্রান্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪২ জন রোগী ঢাকার। এছাড়া চট্টগ্রামে ২৪৬ জন, রাজশাহীতে ১৭৫ জন, খুলনায় ১৪১ জন, বরিশালে ৭৯ জন, সিলেটে ৬১ জন, ময়মনসিংহে ৪০ জন এবং রংপুর জেলায় ৩৪ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। পুরুষ যৌনকর্মীদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া পুরুষ সমকামীদের মধ্যেও এই রোগ ছড়াচ্ছে। যারা ইনজেকশন ব্যবহার করে শিরায় মাদক নেন, সেইসব মাদকসেবীরাও এইডসে আক্রান্ত হচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, বাংলাদেশ অনেক রোগ নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও এইডস নিয়ন্ত্রণ থমকে আছে। এইডস নির্মূলে রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সায় আরও বেশি জোর দেয়ার তাগিদ দিয়ে এই চিকিত্সক রোগটি যাতে সংক্রমিত না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, আক্রান্তদের দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। সরকার এইডসের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সা, ওষুধসহ সবধরনের সেবা দিচ্ছে। আমাদের এখানে অস্ত্রোপচারসহ চিকিত্সায় রি-ইউজেবল অনেক কিছু ব্যবহার করা হয়। ওই জিনিসগুলো জীবাণুমুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দেখা যাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তি যিনি একটি কোলনস্কপি, এন্ডোস্কপি বা যে কোনো এক একটা পরীক্ষা করাতে এসে আক্রান্ত হয়ে গেলেন।

রোগটি বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, সারাবিশ্বে এখন অবাধ যাতায়াত করছে। ফলে সংক্রামক রোগও দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। মৃত্যুর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য দুটো কারণ তুলে ধরেন চিকিত্সক আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, আগে হয়তো অজ্ঞাত রোগ হিসেবে মারা যেত। এখন এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ভালো হওয়ায় রোগী শনাক্ত বেশি হচ্ছে, এইডস আক্রান্তের মৃত্যু এইডস হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে। আরেকটা হতে পারে বাংলাদেশে যারা এইডস আক্রান্ত তাদের বয়স হয়েছে, তাদের অনেকের ন্যাচারাল ডেথ হচ্ছে।

তথ্যমতে, গত এক বছর নতুনভাবে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক। শিরায় মাদক গ্রহণকারী ও পুরুষ সমকামীদের মধ্যে সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি। ঢাকা বিভাগের পর নতুন সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে ফেরত আসা শ্রমিকদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যাচ্ছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। বিদেশ থেকে দেশে আসার সময়ও তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হওয়া উচিত।

এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পরিচালক মো. খুরশিদ আলম বলেন, দেশে অনুমিত এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩। এর ৬৭ শতাংশকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তারা চিকিত্সা নিচ্ছেন, এবং তাদের ৯০ শতাংশের শরীরের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে। এইচআইভি বা এইডস পরীক্ষাসহ চিকিত্সার সব খরচ সরকার বিনা মূল্যে দেয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, ব্যক্তি-মালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এইচআইভি পরীক্ষা করা গেলে বেশি মানুষকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তবে বিদেশফেরত শ্রমিকদের জাতীয় কর্মসূচির আওতায় রাখা কিছুটা চ্যালেঞ্জের।