রোহিঙ্গাদের জন্য বছরে ব্যয় হবে ৪ হাজার কোটি টাকা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দমন-পীড়ন থেকে প্রাণ বাঁচাতে গত এক মাসে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে ১ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু-নারী-পুরুষের। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের বর্বর হামলায় ২০১৫ সালের শেষের দিকে ভিটেমাটি ছেড়ে আসেন আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। আর আশির দশক থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। সেই হিসাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে আনুমানিক ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। বিশাল সংখ্যার এই শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানের সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। আবার পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বাড়তি চাপ পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১৬০২ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই। সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্প্রতি দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা, অতিবৃষ্টিতে সড়ক-রেলপথসহ নানা ধরনের অবকাঠামো খাতে লাখো কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। এ জন্য বিদেশ থেকে চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির পথ বেছে নিতে হয়েছে। এর মধ্যেই লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটছে। তাদের নিয়ে জাতীয় কোনো পরিকল্পনা না থাকায় আর্থিকভাবে নতুন করে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, ৬ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশের ফলে দেশের জনমিতির ওপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরা কোনো ধরনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারায় দেশের মাথাপিছু আয়ে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে।

নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কক্সবাজারই নয়, রোহিঙ্গারা পুরো বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা অনেকেই ইয়াবা সরবরাহকারী, চোরাচালানি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-েও সরাসরি জড়িত। বাংলাদেশি ভূখ- দখলসহ নানাভাবে তারা স্থানীয় শ্রমবাজার দখল করে আছে। এমনকি বাংলাদেশি ভোটার আইডি কার্ড গ্রহণ করে বাংলাদেশি নাগরিকও হচ্ছে। এখনকার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা ইসরাইলি ইহুদিদের মতো অদূর ভবিষ্যতে দেশের গলার কাঁটা হয়েও দাঁড়াতে পারে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে শরণার্র্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেই উন্নত দেশগুলোয় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। এসব মানুষের একটা অংশ দেশ ছাড়ছে জীবিকার টানে, উন্নত জীবনযাপনের আশায়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ভিন্ন। তাদের সে ধরনের উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। তারা শুধু প্রাণে বাঁচার তাগিদে নিজ বসতভিটা ছেড়ে আসছে। এটা অত্যন্ত মানবিক। মানবিক দৃষ্টিতে তাই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াই উচিত।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কান্ট্রি প্রধান আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্প করে বসবাসের সুযোগ দিলে এরা নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারবে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা কম। পরে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এদের নিজ দেশে ফেরানো সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

কক্সবাজারের জনসংখ্যা ২০ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৭ জন। বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, মোট জনসংখ্যার বাইরে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আছে আরও ৬ লাখ। সেই হিসাবে কক্সবাজারে চারজনেরও কম বাংলাদেশি নাগরিকের বিপরীতে একজন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। পাহাড় বা বনভূমির বড় একটা অংশ দখল করে আছে এসব রোহিঙ্গা। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি জীবিকার অন্বেষণে বনের কাঠ বিক্রি, মৎস্য আহরণ করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এসব নাগরিক। যেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে সাগর-নদীতে মৎস্য আহরণের পথ দিনদিন সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জীবিকার টানে জেলের পেশা বেছে নিয়েছে; ঢুকে পড়েছে গণপরিবহন খাতেও। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেই আয়ের পথ খুঁজে নিয়েছে। এতে সরাসরি অর্থনৈতিক খাতে ভাগ বসাচ্ছে তারা। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা নতুন করে কর্মক্ষেত্র খুঁজবে। এতে আরও সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। এ জন্য এখনই রোহিঙ্গাদের নিয়ে করণীয় সম্পর্কে সরকারের ভাবা উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা।

প্রধান বন সংরক্ষকের কাছে পাঠানো কক্সবাজার বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। এর বাইরেও পাবর্ত্য জেলাগুলোয় অনিবন্ধিতভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রোহিঙ্গারা। তারা রাতের আঁধারে কিংবা দিনের বেলাতেই অবৈধভাবে বন কেটে কাঠ পাচার করছে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও থামানো যাচ্ছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত ক্যাম্পের আশপাশে প্রতিনিয়ত ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে বাগান নষ্ট করে; গাছের গুঁড়ি বিক্রি, কবরস্থান তৈরি ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে বনভূমি দখলে লিপ্ত। এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। বনবিভাগের তথ্যমতে, জেলার দক্ষিণ ও উত্তর রেঞ্জে বনভূমির আয়তন ২ লাখ হেক্টরের মতো। এ বনভূমির একটা বড় অংশই দিনদিন রোহিঙ্গাদের অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। সূত্র-আমাদের সময়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, ০৮ সেপ্টেম্বর  ২০১৭