তাওয়াক্কুল একটি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মহৎ গুণ, জুমার খুৎবাহ পূর্ব বয়ান

ইসলামের পরিভাষায় যেকোনো প্রয়োজন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করাকে তাওয়াক্কুল বলে। আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায় তাওয়াক্কুল। মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারী লোকদেরকে ভালবাসেন। আজ জুমার খুৎবাহ পূর্ব বয়ানে পেশ ইমাম এসব কথা বলেন। নগরীর মসজিদগুলোতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রচুর মুসল্লির সমাগম ঘটে। মহাখালীস্থ মসজিদে গাউছুল আজম কমপ্লেক্সেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রচুর মুসল্লি জুমার নামাজে অংশ নেন।

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি এহেসানুল হক জিলানী আজ জুমার খুৎবাপূর্ব বয়ানে বলেন, মআল্লাহ তায়ালা বান্দার উপর অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দান করেছেন যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন “যদি তোমরা আমি আল্লাহর নেয়ামত গুলোকে গণনা করো, গণনা করে শেষ করতে পারবা না”। এই নেয়ামত গুলোর মধ্যে সময় অনেক বড় দামি নেয়ামত । সময় এত বড় নেয়ামত যে, এই সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষ জান্নাতী হয়ে যেতে পারে। এর বিপরীত এই সময়কে কাজে না লাগানোর কারণে মানুষ জাহান্নামী হয়ে যেতে পারে। এ জন্যই তো আল্লাহ তায়ালা বান্দাদেরকে ধমক এবং তিরস্কার করে কেয়ামতের দিন বলবেন,”আমি কি তোমাদেরকে এতটুকু বয়স এবং সময় দেয়নি, যে সময়কে তোমরা উপদেশের কাজে এবং নেক আমলের কাজে লাগাতে পারতে? “আল্লাহ তায়ালা সূরা আছরে সময়ের কসম খেয়ে বলেছেন “সময়ের কসম, নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত । তবে যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং সত্যের উপদেশ দিয়েছে, সবরের উপদেশ দিয়েছে তারা ব্যতীত। “এই কসম থেকেও বুঝা যায় সময়ের গুরুত্ব কতখানি। যে বিষয়টাকে বড় মনে করা হয় তার উল্লেখ করেই কসম খাওয়া হয়, অন্য কিছুর নামে কসম খাওয়া হয়না। কাজেই সময়কে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে কোন কোন কাজে লাগাতে হবে তাও আল্লাহ তায়ালা এই সূরায় বলে দিয়েছেন যারা নিজেরা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে । অন্যকেও ঈমানের কথা বলে, আমলের কথা বলে।এখানে মোট চারটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই চারটা কাজে যাদের সময় লাগবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক সময় আমরা সময়ের ব্যাপারে ধোকা খায়। মনে করি আজ নয় কাল করব এখন নয় আগামীতে করবো এভাবে আগামীর চক্করে পড়ে এক সময় মৃত্যু এসে যায়। সময়কে আর কাজে লাগানো হয় না। সময় এবং সুস্থতা উভয়ের ব্যাপারে আমরা এরকম ধোকা খায়। তাই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর বড় দুটি নেয়ামত রয়েছে, যে ব্যাপারে মানুষ ধোকা খায়। সে দুটি নেয়ামত হল সুস্থতা ও অবসরতা “অন্য হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন “পাঁচটি জিনিস আসার আগে পাঁচটি জিনিসকে কাজে লাগাও, বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে কাজে লাগাও, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে কাজে লাগাও, অভাব আসার আগে সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও, ব্যস্ততা আসার আগে অবসরতাকে কাজে লাগাও, মৃত্যু আসার আগে জীবনকে কাজে লাগাও। “এই হাদীসে বুঝানো হয়েছে যে আগামীতে করবো সামনে করবো এই চক্করে পড়বে না বরং এখনই কাজ শুরু করে দাও। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকার বাংলা মটরস্থ বাইতুল মোবারক জামে মসজিদের অসারারী খতিব অধ্যাপক ড. মাওলানা আব্দুর রশিদ আজ জুমার খুৎবাপূর্ব বয়ানে বলেন, মানুষের ভালো-মন্দ, উন্নতি-অবনতি সবকিছুই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। যে কারণে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা মানুষের কর্তব্য। আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখাকেই পরিভাষায় তাওয়াক্কুল বলা হয়।
তাওয়াক্কুল শব্দটি আরবি। এর অর্থ নির্ভর করা, ভরসা করা, আস্থা রাখা। ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’ অর্থ হলো আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ইসলামের পরিভাষায় যেকোনো প্রয়োজন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করাকে তাওয়াক্কুল বলে। আল্লাহর ওপর যার আস্থা যত বেশি, তার সফলতা ও পরিপূর্ণতা তত বেশি। কারণ সফলতা একমাত্র আল্লাহরই হাতে। আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায় তাওয়াক্কুল।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হও। (আল কোরআন, ৫:২৩) তাওয়াক্কুল মহান আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারী লোকদেরকে ভালবাসেন। (আল কোরআন, ৩:১৫৯) তাওয়াক্কুলকারী লোকদেরকে মহান আল্লাহ সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করেন। তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম রিযিকের ব্যবস্থা করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দিবেন, এবং তাকে তার ধারনাতীত উৎস থেকে রিয্ক দান করবেনে। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (আল কোরআন, ৬৫:২,৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালার প্রতি যে রূপ তাওয়াক্কুল করা উচিত তোমরা যদি তাঁর প্রতি সে রূপ তাওয়াক্কুল করতে পার তবে তিনি তোমাদেরকে রিয্ক দান করবেন। পশু পাখিরা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে বেরিয়ে যায় এবং দিন শেষে পূর্ণ উদরে তৃপ্ত হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। (তিরমিযি শরীফ, ইবনে মাজা শরীফ) তাওয়াক্কুল অভাবী ব্যক্তির অভাব মোচনের একটি কার্যকর মাধ্যম। ইবনু মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোন ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, অত:পর তার অভাবের কথা মানুষের কাছে পেশ করে, তবে তার অভাব দুর করা হবে না। আর যে ব্যক্তি তা আল্লাহর কাছে পেশ করে, অনতিবিলম্বে আল্লাহ তাকে অভাব মুক্ত করে দিবেন। (আবু দাউদ শরীফ)
পার্থিব জীবনে সাফল্য ও উন্নতি লাভের অন্যতম শর্ত তাওয়াক্কুল। তাওয়াক্কুলকারীকেই প্রদান করা হয় সম্মান ও বিজয়। মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের উপর জয়ী হবার কেউ থাকবেনা। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? মুমিনগণ আল্লাহর উপরই তাওয়াক্কুল করুক। (আল কুরআন, ৩:১৬০)

তাওয়াক্কুল একটি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মহৎ গুণ। যার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা যত উন্নত তাঁর তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষ তত অধিক। আল্লাহকে যিনি যত বেশী ভালবাসতে পারেন, তাঁর সত্ত্বাতে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন, তাঁর খুশী রেজামন্দিকে যত বেশী জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বানাতে পারেন তাঁর তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষও হয় তত অধিক। তাওয়াক্কুল একটি গুণ, একটি ইবাদত। এটি অর্জন ছাড়া ঈমান অসম্পূর্ণ থাকে। আবার যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (আল কোরআন, ৬৫ : ৩)
প্রচেষ্টা ব্যতীত তাওয়াক্কুল ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। সাফল্য লাভের জন্য, কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতে ইসলামে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি উট বেঁধে রেখে আল্লাহর উপর ভরসা করব, না বন্ধনমুক্ত রেখে? তিনি বললেন, উট বেঁধে নাও, অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। (তিরমিযি শরীফ)
মহান আল্লাহ জীবনের সর্বাবস্থায় তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার তৌফিক আমাদের দান করুন, তাঁর প্রিয় বান্দা হিসেবে আমাদের কবুল করুণ। আমিন।

মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী আজ জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে বলেন, মানব সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ প্রতিবেশী। ফলে ইসলামে প্রতিবেশীর হককে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী বলতে মুসলিম, কাফের, নেক বান্দা, ফাসেক, বন্ধু, শত্রæ, পরদেশী, স্বদেশী, উপকারী, ক্ষতিসাধনকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, নিকটতম বা তুলনামূলক একটু দূরের প্রতিবেশী, রাস্তাঘাটে চলার পথে সাময়িক প্রতিবেশী সবাই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে বলেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং কোনো কিছুকে তার সাথে শরিক করো না। এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ, নিকট-প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, চলার পথের সাময়িক সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তার ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি তার সাথে কাউকে শরিক না করার কথা বলেছেন। সাথে সাথে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হক। তার মধ্যে রয়েছে মাতা-পিতার হক, আত্মীয় স্বজনের হক, এতীমের হক ইত্যাদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সাথেই আল্লাহ তায়ালা প্রতিবেশীর হককে উল্লেখ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রতিবেশীর হককে আল্লাহ কত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য কত জরুরি। খতিব আরও বলেন, প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল আ. আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ দিয়েছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছের অংশীদার বানিয়ে দেয়া হবে। (বুখারী, হাদীস নং-৬০১৪)। কিন্তু আজকাল এ বিষয়ে আমাদের মাঝে চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে শহরের মানুষের মাঝে। বছরের পর বছর পার হয় পাশের বাড়ির কারো সাথে কোনো কথা হয় না, খোঁজ খবর নেয়া হয় না। বরং বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া হয়। অথচ প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ ও তাকে কষ্ট না দেয়াকে ঈমানের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে। (মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫)। আরেক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (মুসলিম, হাদীস নং-১৮৩)। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন আমীন।