যেভাবে পড়বেন পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ

ঈদ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ঈদের নামাজ। এই নামাজ ওয়াজিব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কখনো তা পরিত্যাগ করেননি; বরং অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করেছেন। ঈদের নামাজ বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ।

 

 

ঈদের নামাজ যেসব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ

ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায়: ঈদগাহ হলো ঈদের নামাজ আদায় করার নির্ধারিত স্থান। ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করা সুন্নত। তবে বৃষ্টি বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে মসজিদেও আদায় করা যায়। বিনা প্রয়োজনে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করা মাকরুহ।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে বেরিয়ে যেতেন। প্রথমে তিনি নামাজ আদায় করতেন। মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে বসা থাকত। তিনি খুতবা দিতেন।
তাতে ওয়াজ-নসিহত করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন। ঈদের নামাজ ও খুতবার পর কোনো বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজন হলে পাঠাতেন। অথবা কোনো বিশেষ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের প্রয়োজন হলে নির্দেশনা দিতেন। অতঃপর ফিরে যেতেন। (বুখারি, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদগাহে বের হওয়া, হাদিস : ৯১৩)
উত্তম পোশাকে নামাজ আদায়: মিসওয়াক করে গোসল করা এবং উত্তম ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন গোসল করেছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩১৫)

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.)-এর লাল রঙের ডোরাকাটা একটি চাদর ছিল, যা তিনি দুই ঈদ ও জুমায় পরিধান করতেন। (নাসবুর রায়াহ, পৃষ্ঠা-২১৮)

 

হেঁটে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফেরা: রাসুলুল্লাহ (সা.) হেঁটে এক রাস্তা দিয়ে ঈদের নামাজে যেতেন আবার অন্য পথ দিয়ে ফিরতেন। এটিই সুন্নাহ। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, সুন্নাহ হলো ঈদগাহের দিকে হেঁটে যাওয়া এবং ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া। (তিরমিজি, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদুল ফিতরের দিন পায়ে হেঁটে যাওয়া, হাদিস : ৫৩০)

 

জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন নামাজ আদায়ের জন্য যাওয়া-আসায় পথ পরিবর্তন করতেন। (বুখারি, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদের দিন ফেরার পথে পথ পরিবর্তন করা, হাদিস : ৯৪৩)

 

ঈদগাহে যেতে তাকবির বলা: রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির বলতেন। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ অর্থাত্ আল্লাহ সব কিছুর চেয়ে বড়, আল্লাহ সব কিছুর চেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই। আর আল্লাহ বড়, আল্লাহই বড়। সব প্রশংসা তাঁরই জন্য।

 

সালেম ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তাঁকে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির বলতেন। (সুনানুদ-দারা কুতনি, অধ্যায় : দুই ঈদ, হাদিস : ৬)

 

ঈদের নামাজের আগে-পরে নামাজ নেই: ঈদের দিন ঈদের নামাজের আগে ও পরে অন্য কোনো সুন্নত বা নফল নামাজ নেই। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন দুই রাকাত নামাজ পড়েছেন। এর আগে ও পরে কোনো নামাজ পড়েননি। (বুখারি, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদের পর খুতবা, হাদিস : ৯২১; মুসলিম, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদের আগে-পরে নামাজ নেই, হাদিস : ২০৯৪)

আজান-ইকামত নেই: ঈদের নামাজে কোনো আজান ও ইকামত নেই। জাবির ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে একাধিকবার দুই ঈদের নামাজ পড়েছি আজান ও ইকামত ছাড়াই। (মুসলিম, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদের নামাজ আজান ও ইকামত ছাড়া, হাদিস : ২০৮)

নির্ধারিত কিরাতে নামাজ আদায়: ঈদের নামাজের প্রথম রাকাতে সুরা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা গাসিয়াহ অথবা প্রথম রাকাতে সুরা ক্বাফ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ক্বামার পাঠ করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজে এসব সুরা পাঠ করতেন। (মুসলিম, অধ্যায় : জুমু‘আ, অনুচ্ছেদ : জুমু‘আর নামাজে যা পড়বে, হাদিস : ২০৬৫)

অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আবু ওয়াকিদ আল লায়সিকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজে কোন সুরা পাঠ করতেন? আবু ওয়াকিদ বলেন, তিনি ক্বাফ ওয়াল কুরআনিল মাজিদ (সুরা ক্বাফ) ও ইক্বতারাবাতিস সায়াতা ওয়ান শাক্কাল ক্বামার (সুরা ক্বামার) পাঠ করতেন। (মুসলিম, অধ্যায় : দুই ঈদ, অনুচ্ছেদ : ঈদের নামাজে যা পড়বে, হাদিস : ২০৯৬)

অতিরিক্ত ছয় তাকবিরে নামাজ আদায় : ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির আছে। প্রতি রাকাতে তিনটি করে অতিরিক্ত তাকবির দিতে হয়। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে নামাজ শুরু করে ছানা পড়ার পর অতিরিক্ত তিন তাকবির এবং দ্বিতীয় রাকাতে কিরাত পাঠের পর রুকুতে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির। ঈদের নামাজ অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করা সহিহ হাদিসসম্মত এবং সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তাবেঈ মাকহুল (রহ.) বলেন, আমাকে আবু হুরায়রা (রা.)-এর সঙ্গী আবু আয়েশা জানিয়েছেন, সাঈদ ইবনে আস (রা). আবু মুসা আশআরি (রা.) ও হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের নামাজে কয় তাকবির দিতেন? আবু মুসা আশআরি (রা.) বললেন, চার তাকবির দিতেন, যেভাবে জানাজায় চার তাকবির দেওয়া হয়। হুজাইফা (রা.) তাঁর কথার সম্মানে বললেন, তিনি ঠিকই বলেছেন। আবু মুসা (রা.) আরো বলেন, আমি যখন বসরার শাসনকর্তা ছিলাম তখন এভাবেই তাকবির দিতাম। আবু আয়েশা বলেন, সাঈদ ইবনে আস (রা.)-এর এই প্রশ্নের সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। (আবু দাউদ, অধ্যায় : নামাজ, অনুচ্ছেদ : ঈদের তাকবির, হাদিস : ১১৫৫; ইবনে আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ, হাদিস : ৫৭৪৪; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদিস : ১৯৭৪৯)

এ হাদিসে চার তাকবিরের কথা উল্লেখ আছে, যার মধ্যে প্রথম রাকাতের প্রথম তাকবিরটি তাকবিরে তাহরিমা, আর দ্বিতীয় রাকাতের চতুর্থ তাকবিরটি রুকুর। এভাবে প্রতি রাকাতে তিন তিন করে মোট ছয়টি অতিরিক্ত তাকবির হয়। সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে এমনটি স্পষ্ট হয়। ইবনে আব্বাস (রা.), ইবনে মাসউদ (রা.), আনাস (রা.), মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) প্রমুখ সাহাবির আমল ও উক্তিতে ছয় তাকবিরের বিষয়টি পাওয়া যায়। যেমন—আবদুল্লাহ ইবনে হারেস বলেন, ঈদের দিন ইবনে আব্বাস (রা.) আমাদের নামাজ পড়িয়েছেন, তিনি ৯ তাকবির দিয়েছেন। প্রথম রাকাতে পাঁচটি ও দ্বিতীয় রাকাতে চারটি। (প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা, রুকুর তাকবির ও অতিরিক্ত তিন তাকবির, আর দ্বিতীয় রাকাতে অতিরিক্ত তিন তাকবির ও রুকুর তাকবির) এবং তিনি দুই রাকাতের কিরাতের মধ্যে (তাকবির দ্বারা বিচ্ছেদ না করে) মিলিয়েছেন। অর্থাত্ প্রথম রাকাতে কিরাতের আগে এবং দ্বিতীয় রাকাতে কিরাতের পরে তাকবির বলেছেন। (ইবনে আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ, হাদিস : ৫৭৫৭)