ভারত-চীন সংঘাতঃ ভারতকে যেভাবে সাহায্য করবে আমেরিকা

গোটা বিশ্ব জুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক একদিকে করোনা অন্নদিকে ভারত- চীন উত্তেজন। ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়া বিচিত্র নয়। চীনের অনমনীয় আগ্রাসন নীতির কারণে ঘটনার গতিপ্রকৃতি কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছে। পূর্ব লাদাখে ভারত-চীন দু’পক্ষই সেনা বাড়ানোয় এমনিতেই উত্তেজনা চরমে রয়েছে। এরপর যদি আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে অবধারিতভাবেই কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে।

গলওয়ান সংঘাত পরবর্তী পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোও বুঝছে। কিন্তু, কেউ-ই প্রকাশ্যে চীনকে তার আগ্রাসন নিয়ে কিছু বলছে না। রাশিয়া এখনও পর্যন্ত মুখ বন্ধই খেখেছে।

গলওয়ান সংঘাতের পর ভারত-চীন দু’পক্ষকে নিয়ে বসার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায় রাশিয়া। কারণ, না ভারত, না চীন কেউই তৃতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপে রাজি হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া কাকে শেষ পর্যন্ত সমর্থন করবে, কার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছে গোটা বিশ্ব। এমনকি রাশিয়া নিজেও চিন্তায় রয়েছে। তার কারণ ভারত তার পুরনো বন্ধু। অন্যদিকে, চীনের সঙ্গেও রাশিয়ার সম্পর্ক এখন ভাল। তাই রাশিয়া পুরনো মিত্র নাকি নয়া মিত্রের পাশে দাঁড়াবে তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি।

ভারতের পাশে আমেরিকা দাঁড়ালে সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া দাঁড়াবে চীনের পিছনে। ভারত-চীন যুদ্ধ যদি শেষ পর্যন্ত বেধেই যায় সেক্ষেত্রে শুধু আমেরিকা নয়, জাপান, অস্ট্রেলিয়াও ভারতের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়বে। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে ভারত-চীন যুদ্ধ এড়ানো কিন্তু এবার মুশকিল। কৃটনৈতিক ও সামরিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে ভারত মীমাংসায় আগ্রহ দেখালেও চীন কিন্তু ভারতের জমি আঁকড়ে বসে রয়েছে। গলওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে তারা ৮০০ মিটার দূরে রয়েছে বলে দাবি করলেও উপগ্রহ চিত্র কিন্তু সে কথা বলছে না। ভারতীয় ভূ-খণ্ডের যে অংশ চীন অবৈধভাবে দখল করে স্থায়ী কাঠোমো গড়ে তুলেছে, সেখান থেকে সরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ভারত যে চীনের এই দখলদারি এবার মানবে না, তা লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতিতেই পরিষ্কার। শুধু গলওয়ানের জমি নয়, লাদাখ থেকে কেড়ে নেওয়া আকসাই চীনের জমিও ভারত এবার বুঝে নিতে চায়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকেই আকসাই চীন তাদের দখলে রেখেছে বেইজিং। বিশেষত, এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন আমেরিকার মতো শক্তিধর বন্ধু পাশে রয়েছে।

তবে, আমেরিকার শক্তিতে ভরসা করেই যে ভারত যুদ্ধে নামবে, তা কিন্তু নয়। চীনকে মোকাবিলায় ভারতের শক্তি কিন্ত কম নেই। লাদাখে ইতিমধ্যে তিন বাহিনীর ১৫ হাজারেরও বিশে সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় ভারতের এই ১৫ হাজার সৈন্যের মোকাবিলায় চীনের অন্তত ৫ লাখ সেনা লাগবে। এমনটাই মনে করেন সমর বিশেষজ্ঞরা।

চীনের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ভারতের অত্যন্ত শক্তিধর ভীষ্ম ট্যাংকও লাদাখে অপেক্ষা করছে। লাদাখ সীমান্তের অবহ চাক্ষুষ করতে ভারতের সেনাপ্রধান নিজে কয়েক দিন আগে ঘুরে গেছেন। ফিল্ড কম্যান্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন উপরতলা থেকে খালি নির্দেশের অপেক্ষা।

এর মধ্যে চীন আর একবার কোনওভাবে প্ররোচানা দিলে তা বারুদে আগুন পড়ার মতোই হবে। সেনাকে ফ্রি-হ্যান্ড দিয়েই রেখেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সেনার হাতেই ছাড়া রয়েছে।

এরপর তো আমেরিকা রইলই। চীনকে বারবার সতর্ক করে থেমে নেই আমেরিকা। মার্কিন সেনা কিন্তু ইউরোপ ছেড়ে এদিকেই আসছে। আর কয়েক দিনের মধ্যে বড় সংখ্যক মার্কিন সেনা চলে আসবে বলে নিশ্চিত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও। আমেরিকার মাথায় শুধু ভারত নয়। একইসঙ্গে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনও রয়েছে। ভারতের মতো এই দেশগুলোও কিন্তু চীনা সেনার অবিরাম হুমকির শিকার। ফলে, চীনকে শায়েস্তা করতে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনকেও সুরক্ষা দেবে আমেরিকা।

চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মির (PLA) মোকাবিলায় কতসংখ্যক মার্কিন সেনা এশিয়ায় মোতায়েন করা হবে, সে হিসাব কষতে বসেছে আমেরিকা। বছরের পর বছর ধরে রাশিয়ার আগ্রাসন সামাল দিতে ইউরোপের একাধিক দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে আমেরিকা। এখন রাশিয়া নয়, চীন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকেই বিশ্বের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর। তাই জার্মানিতে মার্কিন ফোর্স ৫২ হাজার থেকে কমিয়ে ২৫ হাজারে নামিয়ে আনবে আমেরিকা। বাকি ২৭ হাজার মার্কিন সেনা আসছে এশিয়ায়। জার্মানির সঙ্গে এ নিয়ে আমেরিকার কথাও হয়েছে।

বর্তমানে দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগর উভয়ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে রয়েছে চীন। সীমান্ত নিয়েও ভারতের মতো একাধিক দেশের সঙ্গে চীনের সংঘাত রয়েছে। বেশ কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জ বেআইনিভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে।

গলওয়ানে চীনা সেনা ভারতের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক সামরিক সংঘাতে জড়ানোর পরই আমেরিকার কিন্তু ধৈর্যের বাধ ভেঙেছে। ১৫ জুন রাতে ওই সংঘর্ষে বিহার রেজিমেন্টের এক অফিসারসহ ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমাগত চীনাসেনার আগ্রাসনও চটিয়েছে আমেরিকাকে। তাই শুধু সেনা নয়, তিন তিনটি মার্কিন রণতরীও চলে এল বলে মনেকরা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো এমন একটা পরিস্থিতি এল কেন? কেন, গোটা বিশ্ব এক হয়ে চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি এবং সামরিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করছে না? যদি সত্যিই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যায়, তার প্রভাব কিন্তু ভারত-চীন গণ্ডি বা শুধু এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীনকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখাই যে আমেরিকার কৌশল, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও সে ইঙ্গিত আগেই দিয়েছেন। পম্পেওর আভাস থেকেই পরিষ্কার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেই চীন আসল অবরোধের মুখে পড়তে চলেছে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো দক্ষিণ চিন সাগরে বারবার চিনের সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হচ্ছে।

আমেরিকা যে তা মানবে না, স্পষ্ট করে দেন পম্পেও। ১৯৮৮ সাল থেকেই ফিলিপাইনের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তি রয়েছে। চীনের ক্রমাগত হুমকির প্রেক্ষিতে ভিয়েতনামও আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। উপকূলরেখার সুরক্ষায় মার্কিন নৌসেনা ভিয়েতনামকে সাহায্য পাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়িয়েছে আমেরিকা। সিঙ্গাপুরের বিমান ও নৌঘাঁটি ব্যবহারেও আমেরিকা চুক্তি করে রেখেছে। এই দেশগুলোতে মার্কিন সেনা সমারোহ বাড়লে চীন চারদিক থেকে ঘেরাটোপের মধ্যে পড়বে।

এছাড়া সরাসরি যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে, তাইওয়ানকেও হুমকি দিয়েছে চীন। তাইওয়ানে মার্কিন সেনার পাকাপাকি কোনও ঘাঁটি না-থাকলেও প্রশিক্ষণ ও নজরদারি চালাতে প্রায়শই যাতায়াত রয়েছে। তিন মার্কিন বিমানবাহী ক্যারিয়ার তাইওয়ানের কাছেই অপেক্ষায় রয়েছ।

চীন এবং তার দোসর উত্তর কোরিয়ার মোকাবিলায় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে। শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায় তিন বাহিনী মিলিয়ে ২৮ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। জাপানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৩ ঘাঁটি রয়েছে আমেরিকার। রয়েছে ৫৪ হাজার সৈন্য। সেখানে ৫০টি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং ২০ হাজার মার্কিন নৌসেনা সবসময় তৈরি রয়েছে। এছাড়া গুয়াম নামে ছোট্ট একটা দ্বীপে আরও ৫ হাজার সৈন্য রয়েছে আমেরিকার।
: এই সময়