মার্কিন নির্বাচন: আমেরিকা-চীন বিচ্ছেদের পরিণতি বিশ্বকে কীভাবে ভোগ করতে হবে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময়জুড়েই ভোটারদের সামনে প্রমাণের চেষ্টা করে গেছেন – চীনের ব্যাপারে কে কার চেয়ে বেশি শক্ত হবেন।

কোনো সন্দেহ নেই যে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে তাদের দু’জনের যিনিই জিতুন না কেন, আমেরিকা এবং চীনের সম্পর্কে যে ভাঙন শুরু হয়েছে – তা থামবে না।

নিউইয়র্কের ফ্লাশিং এলাকায় চায়না টাউন দেখলে হঠাৎ মনে হতে পারে আপনি হয়তো বেইজিংয়ে চলে এসেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চায়না টাউনগুলোর অন্যতম এটি। কিন্তু চীন ও আমেরিকার সম্পর্ক এখন আদৌ ভালো নয়, এবং দিনকে দিন সেই সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

আমি অনেকদিন এদেশে রয়েছি, এবং সব সময়ই মনে হয়েছে আমি এখানে কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু হাওয়া বদলে যাচ্ছে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার ধাক্কা বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বের প্রতিটি কোণায় পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তা উদম করে দিয়েছে।

নিউইয়র্কের ফ্লাসিংয়ে এই চায়না টাউনেও এই বৈরিতার ঢেউ এসে লাগতে শুরু করেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনা মেসেজিং এবং ফোন অ্যাপ উইচ্যাট নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এখানকার চীনা-আমেরিকান বাসিন্দাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ তাদের অনেকেই এই অ্যাপ দিয়ে চীনে তাদের বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন।

নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হওয়ার যুক্তিতে হুয়াওয়ে বা টিকটকের মত চীনের প্রধান প্রধান প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা শুরু করেছে আমেরিকা। সেই তালিকায় এখন যোগ হয়েছে উই-চ্যাট।

নিউইয়র্কের চীনা-আমেরিকান আইনজীবী শেনইয়াং উ যুক্তরাষ্ট্রে উই-চ্যাট নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, “এটা বৈষম্যমূলক একটি সিদ্ধান্ত কারণ আমেরিকার চীনা বংশোদ্ভূতরা প্রচুর সংখ্যায় নিয়মিত উই-চ্যাট ব্যবহার করে। ফলে এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার চীনা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য।“

মার্কিন সরকার বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের ওপর নজরদারির জন্য উই-চ্যাটকে কাজে লাগাচ্ছে চীন। কিন্তু আইনজীবী শেনইয়াং বলছেন, এটি খোঁড়া যুক্তি।

তার কথা – চীনা অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে স্বাদ বা অভিজ্ঞতা পাচ্ছে সেটা উই-চ্যাটের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে এবং চীনে তাদের পরিচিত বা স্বজনদের সঙ্গে শেয়ার করছে।

তিনি বলছেন, উই-চ্যাট বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে চীনে এবং বিশ্বের অন্যত্র আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রসারিত করার প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি করা হলো।

প্রযুক্তি, বাণিজ্য এবং হালে কোভিড-১৯ নিয়ে চীন ও আমেরিকা যত বেশি মুখোমুখি হচ্ছে, তত বেশি চাপে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী।

কীভাবে শুরু এই শত্রুতার:
তবে দুই পরাশক্তির মধ্যে এই শত্রুতা একদিনে তৈরি হয়নি। কয়েক দশক ধরে এটি ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এবং সন্দেহ নেই যে এই রেষারেষির পরিণতি থেকে খুব কমই দেশই রেহাই পাবে।

একটু পেছনের দিকে তাকানো যাক। কয়েক দশক ধরে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীন সফরে যান। তবে ঐ সফরের পরেও সম্পর্ক ছিল কম-বেশি ঠাণ্ডা এবং তাতে নিয়মিত ওঠাপড়া চলেছে।

এরপর ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্রদের ওপর গুলির পর চীন-মার্কিন সম্পর্ক দারুণভাবে পোড় খায়। তার দশ বছর পর ১৯৯৯ সালে বেলগ্রেডে চীনা দূতাবাসে মার্কিন বোমা বর্ষণের ঘটনায় তিক্ততা চরমে পৌঁছে।

কিন্তু ২০০১ সালের দিকে পরিস্থিতি ইতিবাচক মোড় নেয়। চীন সে বছর আমেরিকার সমর্থনেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়, এবং তখন থেকে শুরু হয় চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অব্যাহত ধারা। দুই পরাশক্তি বিশ্ব বাণিজ্যে সহযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয়। তবে তখন থেকেই আমেরিকার মধ্যে অসন্তোষ ছিল যে চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে স্বার্থপরের মত আচরণ করছে, প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করছে।

“চীনের বাজার কখনই শতভাগ মুক্ত ছিলনা,“ বিবিসিকে বলেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক স্কট কেনেডি।

তিনি বলেন, “চীনা অর্থনীতির যত উন্নতি হয়েছে ততই বাণিজ্যে নতুন নতুন বিধিনিষেধ চাপানো হয়েছে। বিশেষ করে শি জিন পিংয়ের ক্ষমতা নেওয়ার পরে এই প্রবণতা বেশি করে দেখা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া, কম্পিউটিং এবং নানা ধরণের মার্কিন প্রযুক্তির ওপর বিধিনিষেধ, শর্ত আরোপ অব্যাহত রয়েছে।“

তবে গত এক দশক ধরে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে রেষারেষি বাড়তে থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাদের মধ্যে সহযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে।

ভূরাজনৈতিক রেষারেষি বাড়লেও সেইসাথে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগও বেড়েছে। অনেকটা যেন স্বামী-স্ত্রীর লড়াইয়ের মত।

বেশিদিন হয়নি যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে শি জিন পিংয়ের প্রশংসা করে বলেন, “আমি তাকে পছন্দ করি। তিনি আমার বন্ধু।“ অবশ্য কালে কালে বিশেষ করে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে যত বেশি নাকাল হয়েছেন মি. ট্রাম্প চীনের ওপর ক্রোধ উগরে দিয়েছেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি এমন কথাও বলেছেন যে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় না আসলে ‘চীনই একসময় আমেরিকা শাসন করবে।‘

সন্দেহ নেই যে চীন এবং আমেরিকার সম্পর্ক এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এবং আমেরিকা এখন চীনের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে। একসময়কার গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করার এই প্রক্রিয়া গত কয়েকবছর ধরে চলছে।

স্কট কেনেডি বলছেন, এই বৈরিতা থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

“আপনাকে হয়ত কোনো একটি পক্ষ নিতে বাধ্য করা হতে পারে। বিষয়টি এমন দাঁড়াতে পারে আপনাকে হয়ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে কার সাথে আপনি ব্যবসা করবেন – আমেরিকার সাথে নাকি চীনের সাথে। ফলে দেশ, কোম্পানি, ছাত্র, চাকুরীজীবী সবাইকে হয়ত একটি কঠিন দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হবে।“ অনিশ্চয়তায় চীনা ছাত্র-ছাত্রীরা

বহুদিন ধরে চীনা ছাত্র-ছাত্রীদের ধ্যান-জ্ঞান ছিল আমেরিকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা। এ মুহূর্তে প্রায় চার লাখ চীনা ছাত্রছাত্রী আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

এরা এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। আমেরিকার সরকার বলছে, চীন থেকে যারা পড়াশোনা করতে আসছে এদের অনেকেই আসলে গুপ্তচর, তাদের প্রধান কাজ প্রযুক্তি চুরি।

চীনা ছাত্র চেন উ বলছেন, এ ধরনের সন্দেহ অন্যায়। বিবিসিকে তিনি বলেন, “চীনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসব সন্দেহ খুবই অন্যায়। ভালো কেরিয়ারের জন্য, সুযোগের জন্য চীনারা আমেরিকাতে পড়তে আসে। তারা উন্নত শিক্ষা চায়। অন্য দেশে নতুন বন্ধু তৈরি করতে চায়“

আমেরিকার বিমানবন্দরগুলোতে এখন চীন থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সন্দেহভাজন প্রযুক্তি পাচারকারী হিসাবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে দেশে ফেরার সময় তাদের ওপর শ্যেন দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। হংকং-ভিত্তিক দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে আমেরিকার বিমানবন্দরগুলোতে ১,১০০রও বেশি চীনা নাগরিকের ইলেকট্রনিক ডিভাইস (ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ঘড়ি) নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা ৬৬ শতাংশ বেশি।

মাস দুয়েক আগে চীনা সরকারি বৃত্তি নিয়ে গবেষণা করতে আসা ১৫ জন শিক্ষার্থীর সাথে চুক্তি গত সপ্তাহে মাঝপথে বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যে ঘটনা নজিরবিহীন।

চেন উ‘র অনেক বন্ধু দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি নিজে আর কতদিন আমেরিকাতে থাকতে পারবেন তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।

“আমি মনে করিনা আমি এখন আর এখানে কাঙ্ক্ষিত। সম্পর্কে রেষারেষি যত বাড়ছে আমি এবং আামার অনেক বন্ধু চীনে বা এশিয়ার অন্য কোথাও চাকরির সুযোগ খুঁজছি।“

চীন ও আমেরিকা দুই দেশেই উগ্র ধরণের জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জো বাইডেন যিনিই জিতুন না কেন এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং চীন ও আমেরিকার মধ্যে দূরত্ব-শত্রুতা বাড়বে যেটি ২১ শতকের ভূ-রাজনীতির প্রধান নিয়ামক হবে।

:বিবিসি বাংলা