দিল্লির শ্মশানে স্বজনের দেহ পোড়ানোর মর্মান্তিক হাহাকার

জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে এক কোটি ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার ৯৬ জন এবং মারা গেছে দুই লাখ চার হাজার ৮১২ জন।

দেশটিতে গত ২৭ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে তিন লাখ ৬২ হাজার ৯০২ জন এবং মারা গেছে তিন হাজার ২৮৫ জন। এর আগের দিন ২৬ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তিন লাখ ১৯ হাজার ৪৩৫ জন এবং মারা গেছে দুই হাজার ৭৬৪ জন।

গতকাল বুধবার দিল্লিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা সাত শ’তে পৌঁছে গেছে। আশঙ্কা, সংখ্যাটা শিগগিরই হাজার ছাড়িয়ে যাবে। শহরের বিভিন্ন শ্মশানের বাইরে রাস্তায় টোকেন নিয়ে মরদেহের দীর্ঘ লাইন। ২০ ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে আগুন পেতে। লাশ ছিঁড়ছে কুকুরে।

শ্মশানের দরজায় দরজায় ঘুরে জায়গা না পেয়ে বরফ চাপা দিয়ে ৪৮ ঘণ্টাও বাড়িতে শব রেখে দিচ্ছেন স্বজনরা। কুকুরের দেহ পোঁতার জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে মৃত মানুষকে পোড়ানোর জন্য।

দিল্লিবাসীর প্রশ্ন, এ যদি নরক না হয়, তা হলে নরক ঠিক কী? দিল্লির সুভাষনগর শ্মশানে টিনের চালের নিচে সারি সারি চিতা জ্বলছে। উড়ছে ছাই।

এ দৃশ্য অবশ্য নতুন নয়। কিন্তু সেই ছাই উড়ে পড়ছে পাশের যে চাতালে, সেই চাতাল ধরেই এখন মরদেহের সর্পিল রেখা। এক ঝলক তাকালেই মাচার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা অন্তত ১৫-২০ জনের দেহ চোখে পড়ে।

পাশের উঁচু বাঁধানো জায়গায় ঘি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন পরিজনরা। এক দুঘণ্টা নয়, ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টাও বসে আছেন কেউ কেউ।

যে প্লাস্টিকের ব্যাগে মরদেহ মোড়া রয়েছে, তার ওপর নাম, নম্বর লেখা। হাতছাড়া হওয়ার ভয় নেই। তাই একটানা বসে না থেকে পোড়া দেহের গন্ধ এবং ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসছেন অনেকে।

শুধু একটি শ্মশানের ছবি নয় এটি। দক্ষিণ দিল্লির বিকাশ নগরে সোমবার রাতে ৩৫ বছর বয়সী এক করোনা রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দীনদয়াল হাসপাতালে।

যথারীতি শয্যা না পেয়ে ফিরে এসে বাড়িতেই রাখা হয়। মাঝরাতে শ্বাসকষ্টে মারা যান তিনি। শেষ রাতে নিকটবর্তী রণহৌলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দেখা যায়, গেট বন্ধ।

অথচ তখনো বাইরে ছয়জনের মরদেহের লাইন। জানা যায়, টোকেন দেওয়া হয়েছে। কখন ডাক আসবে বলা যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরে বরফবন্দি করে রাখা হয় মরদেহ।

সুভাষনগরের শ্মশানে করোনায় মৃত বাবার দেহ নিয়ে গিয়েছিলেন ৪০ বছর বয়সী মনমীত সিং। তিনি বলেন, অ্যাম্বুল্যান্স, গাড়ির ভিড় কাটিয়ে শ্মশানে ঢুকতে যাবেন, তার আগেই রাস্তা আটকালেন এক কর্মী। জানিয়ে দিলেন, আর দেহ নেওয়া যাবে না। কারণ দাহ করার জায়গা এবং কাঠ নেই। আর সিএনজি চুল্লিতে একসঙ্গে দুজনের বেশি দেহ দাহ করা যায় না। তাতেও একেকটি দেহের পেছনে কমপক্ষে ৯০ মিনিট সময় লাগবে।

এরই মধ্যে লাইনে ২৪ জনের দেহ রয়েছে। তাই অন্য কোথাও যেতে হবে তাকে। এর পর পশ্চিম বিহার এলাকার একটি শ্মশানে গিয়ে বাবাকে দাহ করেন তিনি।

মনমীত আরো বলেন, সরকার হাসপাতালে অক্সিজেন দিতে পারছে না। অন্তত শ্মশানে জায়গা তো দিক, যাতে পৃথিবী থেকে বিদায়টা ঠিকমতো হয়!