গত কয়েক সপ্তাহে আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়েছে দীর্ঘদিনের আশঙ্কা করা গৃহযুদ্ধ

আফগানিস্তান থেকে ব্যাপক সংখ্যক সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ১৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটি থেকে অর্ধেকেরও বেশি সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যে ছয়টি ভবনও হস্তান্তর করেছে মার্কিন বাহিনী। গত সপ্তাহের ন্যাটো সম্মেলন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের শেষ পদক্ষেপ ছিল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী এ বছরের ১১ সেপ্টম্বরের মধ্যে দেশটি থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে। গত ১৪ জুন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে ন্যাটো মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে প্রতীকী বিদায় জানিয়েছে। কিন্তু বিদেশি সেনারা সরে যাওয়ার ফলে দীর্ঘদিনের আশঙ্কা করা গৃহযুদ্ধ দেশটিতে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি আরও ভয়াবহ হওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

ন্যাটো সম্মেলনে উপস্থিত উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে জো বাইডেনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন ন্যাটোর নেতারা। ২ হাজার ৪৪২ জন মার্কিন সেনা ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ১ হাজার ১১৪ জন সেনা গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন। এই সময়ে আফগান অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র একাই ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পশ্চিমা জোট এখন বুঝতে পেরেছে আফগানিস্তান থেকে তাদের বিদায় সন্নিকটে।

কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইউরোপীয় প্রোগ্রামের পরিচালক এরিক ব্রাটবার্গ বলেন, ‘আপনি এটা বুঝতে পারবেন যে, বড় ধরনের কোনো চুক্তির চেয়ে ন্যাটো নেতারা সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চান। তারা অন্যদিকে মনোযোগ দেবেন। এ বিষয়টি ন্যাটোর জন্য ভালো হতে পারে তবে সেনা প্রত্যাহারের ফলে আফগানিস্তানে জীবন ও স্বাধীনতার ওপর যে প্রভাব পড়বে তা খুব সহজ হবে না।’

আফগানিস্তানে সহিংসতা, এমনকি বিদেশি সেনা মোতায়েনের পরও যে সহিংসতা হয়েছে- সে বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে যে সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের আক্রমণ আফগান সরকার মোকাবিলা করতে পারবে কিনা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে অনুযায়ী, তালেবান এখন তার দীর্ঘকালীন মিত্র আল-কায়েদা সঙ্গে শক্তি সঞ্চয় করছে।

আফগান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মহিব বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে আল-কায়েদা মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। আল-কায়েদা ও খোরাসান প্রদেশে ইসলামিক স্টেট (আইএসকেপি) যৌথভাবে তালেবানের সঙ্গে কাজ করছে।’

আফগানিস্তানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহও নিশ্চিত করেছেন যে, তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন সিনেটে এক শুনানিতে বলেন, ‘দুই বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পুনঃজাগ্রত হওয়ার অবশ্যই সম্ভাবনা রয়েছে।’

জাতিসংঘের অ্যানালাইটিক্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড স্যাঙ্কশন মনিটরিং টিম’র একটি প্রতিবেদনে গত সপ্তাহে বলা হয়েছে, অসম্ভব না হলেও আল-কায়েদাকে তালেবান ও এর মিত্রদের থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাবে। এতে আরও বলা হয়, আয়মান আল জাওহিরিসহ আল-কায়েদার শতাধিক নেতা তালেবানকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চলে আশ্রয় দিচ্ছে। আল-কায়েদা ও তালেবানের মধ্যে প্রধান সংযোগকারী হিসেবে হাক্বানি নেটওয়ার্ককের কথা বলা হয় জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আল-কায়েদা এবং হাক্বানি নেটওয়ার্ক আদর্শ ও সংগ্রামের দিক থেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পাকিস্তান হাক্বানি নেটওয়ার্ককে কয়েক দশক ধরে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র হাক্বানি নেটওয়ার্ককে ২০১২ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং একে সমর্থন ও সহযোগিতা না করে পাকিস্তানকে এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার কথা বারবার বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, কত দ্রুত তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখল করবে এর চেয়ে আরও প্রশ্ন রয়েছে। কাবুলভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আতিকউল্লাহ আমখাইল ডয়চেভেলেকে সংক্ষিপ্তভাবে বলেন, ‘গত বছরের দোহায় যুক্তরাষ্ট্র –তালেবান চুক্তি এবং শর্তহীনভাবে ন্যাটোসেনাদের প্রত্যাহার তালেবানদের মনোবলকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। তালেবান নেতারা জানে তারা কাবুল সরকারকে পরাজিত করতে পারবে। আমরা আফগান জেলাগুলোতে তাদের হামলার মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখেছি।’

আফগান পার্লামেন্টের সদস্য রাইহানা আজাদ বলেন, ‘তালেবানরা আগের থেকে শক্তিশালী হচ্ছে। আইএস এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপ আফগানিস্তানে তাদের দৃঢ় অবস্থান তৈরি করছে। এ ছাড়া হঠাৎ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ফলে আগানিস্তান ছাড়াও এই অঞ্চল ও বিশ্ব বিপদের মুখে পড়বে।’

ইতোমধ্যে, আফগানিস্তানে যে গৃহযুদ্ধে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা সেনা প্রত্যাহার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে। গত এপ্রিল থেকে মে মাসে সন্ত্রাসী সংঘর্ষে তা প্রতিফলিত হয়েছে। এপ্রিলে এইসব সংঘর্ষে ১ হাজার ৬৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে যেখানে মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭৫ জনে। এপ্রিলে ৩৮৮ জন আফগান নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয়েছেন এবং মে মাসে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১৩৪ জন। তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেন, গত এক মাসে ১ হাজার ৩০০ নিরাপত্তা কর্মকর্তা তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন।

বিদেশি বাহিনীর বিমান সহযোগিতার অভাবে আফগান সরকার পাঁচটি জেলা এবং নিরাপত্তা চেকপোস্ট তালেবানদের কাছে হারিয়েছে। অন্যদিকে তালেবান সরকার বলেছে, গত এক মাসে ৩ হাজার ৯৯১ জন তালেবান জঙ্গি নিহত হয়েছেন এবং ২ হাজার ১৪১ জন সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

যেহেতু সহিংসতা বাড়ছে এবং আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে, আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগুলোর নেতারা গৃহযুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাজিক নেতা আহমাদ মাসুদ হুঁশিয়ারি করেছেন, যদি তালেবান সামরিক সমাধানের পথ খোঁজে তবে আফগান মুজাহিদিন গ্রুপ তাদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি নেবে। হাজারা নেতা মোহাম্মদ করিম খলিলি হাজারাত অঞ্চলে (বামায়ান, দায়কুন্দি, ঘর, উরুজগান এবং ওয়ারডাক প্রদেশ) নিরাপত্তাবস্থার অবনতির অপেক্ষা করছেন। তারা তালেবানদের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রাক্তন মুজাহিদিন কমান্ডার এবং বাল্ক প্রদেশের গভর্নর আতা মুহাম্মদ নুর বলেছেন, তার সম্মিলিত গ্রুপ তালেবানকে প্রতিহত করবে এবং সরকারের পাশে দাঁড়াবে।

আফগানিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং পশ্চিম আফগানিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী মুহাম্মদ ইসমাইল খান হেরাত প্রদেশে তার বাসভবনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানটি ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করাহয়। সেখানে কয়েকটি অস্ত্রধারী গ্রুপ তালেবানকে প্রতিহত করতে আবেদন করেছিলেন। ইঙ্গিত রয়েছে, কাবুল সরকার তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত।

আফগান গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিউরিটির (এনডিএস) প্রধান আহমাদ জিয়া সরাজ বলেছেন, ‘তালেবানকে প্রতিহত করতে এবং আফগানিস্তানকে গোঁড়া ইসলামি আমিরাত না বানাতে সকল অস্ত্রধারী গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

সংবাদ সূত্রঃ দি ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ইএফএসএএস)