মিয়ানমার জনগণের বিশ্বাস হারাচ্ছেন সু চি

মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা তিনি। দীর্ঘদিনের কর্কশ মিলিটারি শাসনের অধীনে গোটা জাতিকে গণতন্ত্র জন্যে লড়াইয়ের মানসিক শক্তি জুগিয়েছিরেন অং সান সু চি। সেই গৃহবন্দি সময়ে সু চির পাশে সব সময় থাকতেন এক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। গণতন্ত্র আনার জন্যে যারা লড়ছিলেন, তাদের দিকে সব সময় তাক করা থাকতো চকচকে বন্দুকের নল। সু চির স্বপ্ন আর লড়াইয়ের প্রতি একনিষ্টভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন সেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মা থিডা। এই মানুষটি সু চির জন্যে এক নির্জন কারাকক্ষ ছয় বছর কাটিয়েছিলেন। রোগে ভুগে মৃত্যুর চেহারা দেখে ফিরেও এসেছেন।

এখন পরিপূর্ণ চিকিৎসক মা থিডা। তিনি ঔপ্যনাসিকও বটে। মানবাধিকারের পক্ষে তার যুদ্ধ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিকমানের সম্মাননাও এনে দিয়েছে তাকে। বর্তমানে মা থিডা তার আইকনিক ব্যক্তিত্ব সু চি-কে নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চান না।

তবে এক সময় তিনি সু চি-কে ‘আমার এমন এক বোন যিনি সর্বদা হৃদয়ের মাঝখানে থাকবেন’ বলেই তুলে ধরতেন।
কিন্তু এখন হৃদয়ের মধ্যে রাখা বোনটিকে নিয়ে মনে অনেক ক্ষোভ তার। তিনি শুধু একা নন। বছরের পর বছর ধরে যারা কারারুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির জন্যে সু চির পাশে ছিলেন, তারা সবাই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। মিয়ানমারের লংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর খুনোখুনি চলছে, তা নিয়ে নেত্রীর ‘এড়িয়ে চলা মনোভাব’কে সরাসরি দায়ী করছেন তারা। সাংবাদিক আর আন্দোলনকারীদের ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। দেশটির এখন পর্যন্ত ক্ষমতাবাদ জেনারেলদের ভয়ে কাতর হয়ে থাকা সু চি কোনভাবেই আর গণতন্ত্রের পথে হাঁটছেন না। সেই সময়ের সু চিকে আর বর্তমানের সু চির মধ্যে দেখা যায় না। এই হতাশ ও বিক্ষুব্ধ মানুষগুলো বরং বলছেন, সু চি ক্ষমতার বলয়ে আবারো বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করছেন তা পূরণে আবারো ঝাঁপ দিতে পারে মিলিটারি।

মা থিডা বলেন, নোবেল জয়ী সু চিকে এক সময় ‘মিয়ানমারের জোয়ান অব আর্ক’ বলে ডাকতাম। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা ভারতের কাছে মহাত্মা গান্ধী যেমন, আমাদের কাছে সু চিও ব্যতিক্রম নন। আমরা আমা করি না যে, তিনি বছর দেড়েকের মধ্যে গোটা দেশের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু মানবাধিকার রক্ষায় শক্ত অবস্থান আশা করেছিলাম তার কাছ থেকে।

২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান নিরাপত্তা বাহিনী আর পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের ধর্মান্ধ অংশের নৃশংসতার শিকার। তখন থেকেই তাদের ওপর অত্যাচর আর হত্যাযজ্ঞ চলছে। কিন্ত এ নিয়ে সু কির কোনো উপযুক্ত ও দৃশ্যমান পদচারণা নেই। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চলছে সমালোচনা।

ইউএস-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। ৩ লাখ ২০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের বসবাসের অযোগ্য ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে পালাতে উত্তাল সাগরে পাড়ি দেন। সেখানে হচ্ছে সলিল সমাধি।

সম্প্রতি আবারো মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন এবং নৃশংসতা মাথাচাড়া দিয়েছে দেশটিতে। রুখে দাঁড়াতে রোহিঙ্গাদের কিছু ছোট ছোট বিদ্রোহি গ্রুপ পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়েছে। এতে ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আর ৭৭ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছে। নেত্রীর অফিস থেকে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এবং সীমান্তের পুলিশ ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করেছে। যারা রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, তাদের সেই প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা হিসাবে দেখছেন রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট বিদ্রোহী দলকে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক বিশ্লেষক স্টেলা নাও ভলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি এই হিংস্র আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সেনাবাহিনী যে খেলা খেলছে, তা আমরা বুঝি। আবার যেহেতু মানুষের ভোটে তিনি (সু চি) নির্বাচিত প্রতিনিধি, কাজেই তার নিজ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জবাবদিহিতা রয়েছে।

যেসব স্থানে নৃশংসতা চলছে, সেখানে জাতিসংঘের তদন্তকারী একটি দলকে ঢুকতে দেয়নি সু চির সরকার। মানবাধিকার রক্ষা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংসতা দমনে সু চির শাসনামলের ব্যর্থতা কিংবা নিরবতা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের যে দৃষ্টিভঙ্গী, তাও প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।

গত ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, শিশুদের আগুনে ফেলে দেওয়া এবং মুসলিম নারীদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের জন্য নিরাপত্তাবাহিনীকে দায়ি করা হয়। কিন্তু সু চির সরকার সাম্প্রতিক রক্তপাতের জন্যে ইসলামিক বিদ্রোহীদের দায়ি করছে।

এমনকি গত বছর সু চির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে ‘মিথ্যাচার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মিয়ানমার বুক এইড অ্যান্ড প্রিভেনশন ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর থান্ট থাও কাউং বলেন, আমাদের দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। মানুষ এখনও তার (সু চি) দল ও সরকারকে সমর্থন করে। তার কাছ থেকে মানুষের আশাবাদ কমাতে হবে। আসরে সমস্যা অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে।

এক সময় সু চি দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন। গৃহবন্দি থেকেছেন ১৫ বছর। তার ব্রিটিশ স্বামী ও দুই সন্তান থেকে বিচ্ছিন ছিলেন। তার ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পার্টি ২০১৫ সালে বিশাল জয় ছিনিয়ে আনে।

সুশীল সমাজের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক তাম্পাদিপা ইনস্টিটিউটের প্রধান খিন জ উইন। তিনি রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে ১১ বছর জেলে জাটিয়েছেন। বলেন, যখন সু চি বিরোধীদলে ছিলেন তখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলতেন। প্রতিবাদে সরব ছিলেন। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই তিনি নিরব হয়ে গেছেন। এখন মিয়ানমার গণতন্ত্রে ফিরে এসেছে। সবাই আশা করেন, এখন থেকে সবকিছুতে অনেকে উদানৈতিকতা দেখা যাবে। কিন্তু তা ঘটেনি।

কিন্তু তার কেন এমন পরিবর্তন? এই প্রশ্নের বিশ্লেষণ সোজা কথা নয়। অল্প কথায় তার ব্যাখ্যাও অসম্ভব। আসলে তিনি ট্র্যাজেডির এমন এক হিরোইন, যাকে অসম্ভব বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া স্বৈরাচারী সেনাবাহিনীর প্রতি নগন্য দুর্বলতাও থাকতে পারে। প্রায় সময়ই সু চি নিজেই বলেছেন যে, সেনাবাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্যের রক্ত তার দেহে প্রবাহিত। তার বাবা জেনারেল অং সান ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

দেশের এক ব্যাঙ্গাত্মক ওয়েবসাইট ‘বার্মা থা দিন নেটওয়ার্ক’ বেশ কৌতুক করে সু চিকে নিয়ে লিখেছে, সু চির অফিস আসলে এখন একটা ক্লোন। যেখানে মিয়ানমার জেনারেলদের ভাড়া করা রাশিয়ান জিনবিজ্ঞানীরা সু চির গণতান্ত্রিক জিনগুলোকে বের করে নিয়েছেন।

থাও কাউং বলেন, তিনি কোনো টেবিলে বসে মিলিটারিদের সঙ্গে হাসিমুখে করমর্দন করতে পারেন, কিন্তু টেবিলের নিচে মিলিটারিরা তাকে লাথি মারে। মিলিটারিরা এখনও রাজনীতিতে রয়েছে। এখনও তারা সংবিধান নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সু চি শুধু মিলিটারিদের বন্দি নন। অভাবটা রয়েছে মানবাধিকার রক্ষায় নৈতিকতার শক্তিশালী অবস্থানে। ক্ষমতাচক্রের বাইরে মিলিটারিকে নিয়ন্ত্রণের সমস্যা মোকাবেলায় সক্ষমতা দরকার। এরই মধ্যে আবার মিলিটারিরা ২০২০ এর নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে।

মিয়ানমারে মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র মার্ক ফারমানের জানান, সু চি হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়। কিন্তু দেশটিতে এমন অনেক স্থান আছে যেখানে নৃশংসতা থেকে নেই এবং সেখানে তার স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ রয়েছে। অথচ সেখানেও নিরব তিনি। অনেক সমস্যা জট বেঁধে রয়েছে যা সামলে নিতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।

দলের ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যদের বের করে দিয়েছেন সু চি। সংবাদমাধ্যমে খুব কম কথা বলেন। উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়ার বদলে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন।

২৬ বছর ধরে মিয়ানমার শাসন করেছেন জেনারেল নি উইন। তার স্বৈরাচারী ও একরোখা মনোভাবের কারণে চারপাশে এমন মানুষগুলোই বিচরণ করতো যারা কেবল তার সিদ্ধান্তের প্রতি ‘হ্যাঁ-সূচক’ মন্তব্যই করতে পারতেন। সু চি মনে হচ্ছে ঠিক তারই পদানুসরণ করছেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে উঠে সু চি হয়তো ভাবেন, তিনি একাই সবকিছু এগিয়ে নিতে পারবেন।

স্টেলা নাও’য়ের মতে, সু চি জীবনের অনেকগুলো বছর বন্দি কাটিয়েছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এখন গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে তিনি নিজেকে করেছেন জনবিচ্ছিন্ন। তিনি আবারো নিজেকে নিজেই বন্দি করেছেন। এখন তিনি যাদের হৃদয় ভেঙে চলেছেন তারা কি আর নেত্রীর জন্যে জীবন বিলিয়ে দেবেন?  সূত্র : ডন

বাংলাদেশ সময় : ১৮২০ ঘণ্টা, ২৯ আগস্ট, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/ডিএ