লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাঃ শোকের মাতম নিহত সুজনের বাড়িতে

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই ২৬ জনের মধ্যে রয়েছে গোপালগঞ্জের সুজন মৃধা (২০)। বর্তমানে ছেলের শোকে ওই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

নিহতের পরিবারের স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সন্তানের মরদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আকুতি জানিয়েছেন নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী।

একই অবস্থা চলছে গুলিতে আহত ওমর শেখের বাড়িতেও। আহত ওমরের বাবা-মা আহত সন্তানকে ফেরত চেয়ে আকুতি জানিয়েছেন।

নিহত ও আহতের পরিবার এই মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পরিবারের অভাব মেটাতে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্র সুজন মৃধা লিবিয়া পাড়ি জমান। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা গ্রামের কৃষক কাবুল মৃধার ছেলে সুজন মৃধা। সুজনের বাবা একই ইউনিয়নের যাত্রাবাড়ী গ্রামের রব মোড়লের মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। এর জন্য দালালকে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেন তিনি।

স্থানীয় মহাজন ও কৃষি জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগার করেন তিনি।পরে তা তুলে দেন দালালের হাতে। তাকে ৩৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে রংয়ের কাজ দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাকে কোনো কাজ দেয়নি দালাল চক্র। বরং মেরে ফেলার ১৭ দিন আগে সুজনকে ওই দেশের মানব পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়।

২৬ মে মানব পাচারকারীরা সুজনের কাছে আরো ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ভয়েস কল পাঠাতে বলে দেশে।ওই ভয়েস কলে সুজনকে মারপিট করার ভয়েস পাঠানো হয়। তখন সুজনের বাবা তাদের কাছে ১ জুন পর্যন্ত সময় চান। কিন্তু তার আগেই ওরা সুজনকে গুলি করে হত্যা করে।

ওই দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি দালাল আমীরের মোবাইল ফোন থেকে ভয়েস কল পাঠানো হয় এবং সোমালিয়ায় আহমেদ মোহাম্মদ আদম সালামের ব্যাংক হিসেবে মুক্তিপণের টাকা পাঠাতে বলা হয়।ব্যাংক অ্যাকাউন্ড নং-০০২৫২৬১৫৮৩৭৪৪৯, সোমালিয়া, মগদিশা।

নিহত সুজনের বাবা কাবুল মৃধা জানান, তিনি অভাবী মানুষ। সামান্য কিছু কৃষিজমি ও বর্গা চাষাবাদ করে ৬ সদস্যের পরিবার কোনো রকমে চলছিলো। তখন প্রতিবেশী যাত্রাপুর গ্রামের রব মোড়ল ৩ লাখ টাকায় ছেলেকে লিবিয়া পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। সেখানে রংয়ের কাজ দেওয়া হবে এবং মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে বলে জানান। তখন তিনি স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে সুদে ও কিছু জমি বন্দক রেখে রব মোড়লকে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেন। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ছেলেকে রব মোড়ল লিবিয়া পাঠায়।

রব মোড়ল মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের মানব পাচারকারী জুলহাস শেখের মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। সেখানে যাওয়ার পর ছেলেকে কোনো কাজ দেয়নি দালাল চক্র। বরং হত্যার ১৭ দিন আগে ছেলেকে লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন। তারা আমার ছেলেকে আটকে রেখে মারপিট করে এবং না খাইয়ে রাখে।

গত ২৬ মে আমার ছেলের ভয়েস কল রেকর্ড করে আমাদের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তখন তাকে মেরে ফেলার হুমকি ও মারপিটের ভয়েস কল রেকর্ড করে পাঠায়। সোমালিয়ার এক নাগরিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলা হয়। আমি ১ জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমি এখন আমার সন্তানের মরদেহ ফেরত চাই আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মানব পাচারকারীদের বিচার চাই।

নিহতের মা চায়না বেগম (৪৫) কান্নাজনিত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরায় দেও। আমার ছেলেকে দালালরা নিয়ে গিয়ে ১৭ দিন কোনো খাবার দেয়নি। মারপিট করেছে। পরে মুক্তিপণ দাবি করে গুলি করে হত্যা করেছে। আমি আমার সন্তানের মরদেহ চাই। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত দালালদের ফাঁসি চাই। যাতে তারা আর কোনো মায়ের কোল খালি করতে না পারে।

একই দাবি জানিয়ে ওই গ্রামের জয়নাল সরদার (৬৫), লিটন মৃধা (৪৫), আকিজুল ইসলাম বাবুল (৬৫) বলেছেন, এই দালাল চক্রের হাতে গোহালা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের আরো বেশ কিছু যুবক বন্দি আছে। আমরা তাদের উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে দালালদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি করছি।

অপরদিকে একই উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের মো. কালাম শেখের ছেলে ওমর শেখ (২২) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লিবিয়ার ত্রিপলি হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনছ্নে। কাঠুরীয়া বাবা পরিবারে একটু স্বচ্ছলতার জন্য ছেলেকে ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা দিয়ে একই গ্রামের দালাল লিয়াকত মোল্লার মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান।

৯ সদস্যের পরিবারের মেঝ ছেলে ওমর শেখ। বড় ছেলে একটি স’মিলে শ্রমিকের কাজ করেন। তাই অভাবে সংসারে একটু সাহায্যের জন্য ছেলে সুদে টাকা এনে লিবিয়া পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ৪ মাসে একটি টাকাও পাঠাতে পারেনি সে। বরং দুই মাসে ছেলেকে ৪ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন খাওয়ার জন্য।

আহত ওমর শেখের বাবা মো. কালাম শেখ ও মা শাহিদা বেগম তার আহত ছেলেকে ফেরত চেয়েছেন। একইসঙ্গে তারা মানব পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন।

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, আমরা বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইউএনওকে পাঠানো হয়েছে। আমরা দালাল চক্রটি ধরতে চেষ্টা চালাচ্ছি।