আলোচিত ফাহিম হত্যাকাণ্ড: জনমনে প্রশ্ন নেপথ্যে কী মাফিয়া

অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মাল্টি-মিলিয়নেয়ার টেক-জায়েন্ট ফাহিম সালেহকে (৩৩) খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া টাইরেস ডেভন হ্যাসপিল (২১) পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিচ্ছে না। অধিকন্তু সে তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছে যে, তার এটর্নির মাধ্যমে কথা বলতে হবে।

স্থানীয় সময় শুক্রবার দুপুরে নিউইয়র্কের ডিটেকটিভ পুলিশ প্রধান রোডনি হ্যারিসন সিটির পুলিশ প্লাজায় অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত এক সংবাদ সম্মেলনে হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ডিগ্রির হত্যার অভিযোগ দায়ের করার তথ্য জানিয়ে বলা হয়, ‘তদন্তের পর ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির পরামর্শক্রমে আরও কিছু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হতে পারে।’

উল্লেখ্য, ৩৩ বছর বয়েসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবি-পরিশ্রমী ও স্বপ্নবাজ ফাহিমকে ১৩ জুলাই সোমবার বেলা পৌনে দু’টার পর লোয়্যার ম্যানহাটনে নিরাপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত ইস্ট হিউস্টন স্ট্রিটের দশতলা ভবনের সপ্তম তলায় (সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারে গতবছর কেনা দুই বেডরুমের) এপার্টমেন্টে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এর পর দিন বেলা সাড়ে ৩টায় ফাহিমের কাজিন ওই ভবনের ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে কলিং বেল টিপলে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করেন হ্যাসপিল।

পুলিশ জানায়, ফাহিমের কাজিন ওই সময় না এলে হ্যাসপিল ফাহিমের খণ্ড-বিখণ্ডিত দেহ স্যুটকেসে ভরে অন্যত্র সরিয়ে ফেলতো। তার আগেই সে ফ্লোরের সমস্ত রক্ত মুছে ফেলার ভেক্যুয়াম মেশিনও ক্রয় করেছিল ম্যানহাটনের ২৩ স্ট্রিটের হোম ডিপো থেকে। একইসময় বৈদ্যুতিক করাতসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রিও ক্রয় করা হয় ফাহিমের ক্রেডিট কার্ডে।

পুলিশ আরও জানায়, ওই ভবন থেকে হোম ডিপোটে যাতায়াতের জন্যে ট্যাক্সি ভাড়াও ফাহিমের ক্রেডিট কার্ডেই পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ ফাহিমকে হত্যার পর তার পকেট থেকে ক্রেডিটকার্ড চুরি করেছিল হ্যাসপিল।

আরও উল্লেখ্য, চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হ্যাসপিলকে গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানের পর ওই সংবাদ সম্মেলনে কারো প্রশ্ন গ্রহণ করা হয়নি।

মামলার বিবরণে প্রকাশ, ৫ বছর আগে ১৬ বছর বয়সে হ্যাসপিলকে ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি দেন ফাহিম। ফাহিমের বিশাল এই ব্যবসার আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব ছিল হ্যাসপিলের ওপর। সে সুবাদে ফাহিমের একাউন্ট থেকে ৯০ হাজার ডলার চুরি করেছে হ্যাসপিল। এ তথ্য জানার পর ফাহিম তাকে পুলিশে না দিয়ে চুরিকৃত অর্থ কিস্তিতে ফেরৎ দেওয়ার সুযোগ দেন। এমনি অবস্থায়ই হ্যাসপিলের নৃশংসতার নিষ্ঠুর বলি হলেন ফাহিম।

পুলিশ জানায়, সোমবার দুপুরে ফাহিমকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর হ্যাসপিল ওই এপার্টমেন্ট ত্যাগ করে পরদিন করাত, ভেক্যুয়াম মেশিনসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে সেখানে ফেরে। স্যুটকেসে ভরার জন্যই সে ফাহিমের দেহকে টুকরা টুকরা করেছিল। সে পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে ফাহিমের কাজিন চলে আসায়। পুরো একদিন ফাহিমের কোনও সাড়া না পেয়ে মঙ্গলবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন তার বোন। ভেতরে ঢুকে তিনি ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য দেখতে পান।

ফাহিমের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল কেটে টুকরো করা। কিছু টুকরো বড় আকারের গার্বেজ ব্যাগেও ভরে রাখা হয়েছিল। পাশেই ছিল একটি বৈদ্যুতিক করাত, তখনও সেটির তার ছিল সকেটের সঙ্গে যুক্ত।

পুলিশ আরও জানায়, ব্রুকলিনের প্রসপেক্ট পার্ক এলাকার একটি ভবনের বাসিন্দা হ্যাসপিল বুধবার থেকেই ম্যানহাটনের ১৭২ ক্রসবি স্টিটে এয়ারবিএনবি এপার্টমেন্টে অবস্থান করছিল। সেটির ভাড়া পরিশোধ করা হচ্ছিল ক্রেডিট কার্ডে। সেই সূত্রেই তাকে পাকড়াও করা হয়েছে।

এদিকে, ফাহিম সালেহ’কে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হ্যাসপিলের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি উঠেছে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঘাতকের বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রির খুনের অভিযোগ দায়ের না করায়।

এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা এটর্নি অশোক কর্মকার এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অপরাধ-বিষয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত এক প্রবাসী শুক্রবার (১৭ জুলাই) রাতে বলেন, ‘নিউইয়র্কে বেসামরিক কোনও নাগরিক কর্তৃক বেসামরিক নাগরিক খুন হলে সেটি সেকেন্ড ডিগ্রি খুন হিসেবেই আদালতে ওঠে। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে ঘাতকের সর্বোচ্চ আজীবন কারাদণ্ড হয়। ফাহিমের ঘাতকের বেলায়ও সেটি ঘটেছে।

এটর্নি কর্মকার বলেন, নিউইয়র্কে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই হ্যাসপিলের যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সে ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।

ফাহিমের ঘাতক গ্রেফতার হওয়ায় প্রবাসীরাও স্বস্তি পেয়েছেন। ফাহিমের পরিবারও স্বস্তিবোধ করলেও ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির অপেক্ষায় থাকবেন বলে জানা গেছে। ঘাতককে ওই ভবনের সন্নিকটে ৭ নম্বর পুলিশ স্টেশনে নেওয়ার পর ফাহিমের ভক্ত-অনুরক্তরা অকুস্থলে এসে শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রদ্ধাঞ্জলির প্রতীক হিসেবে পুষ্প অর্পণ করেন। ফাহিমের আত্মার শান্তি কামনা এবং ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে নিউ অর্লিন্স থেকে একটি বিশেষ ভার্চুয়াল দোয়া-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় শুক্রবার রাতে।

সেখানকার ডেলাগো কমিউনিটি কলেজের চ্যান্সেলর এবং নিউ অর্লিন্স আঞ্চলিক ট্র্যাঞ্জিট অথরিটির কমিশনার ড. মোস্তফা সারোয়ার জানান, ফাহিমের ভক্ত-অনুরক্ত ছাড়াও শোকে মুহ্যমান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রবাসীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। বাংলাদেশ, নেপাল, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়ায় ‘পাঠাও’ রাইড শেয়ারিং প্রথার প্রচলন ঘটিয়ে ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ার রাজধানী লাসগোতে ফাহিম চালু করেছিলেন ‘গোকাডা’। অর্থাৎ উন্নয়নশীল বিশ্বের যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সামগ্রিক উন্নয়নের দিশা হতে চেয়েছিলেন ফাহিম।

এদিকে, ১৬ বছর বয়সের হ্যাসপিলকে গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বে কেন অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল সে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। উচ্চ শিক্ষার মাঝেই উদ্ভাবনী মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে বহু অর্থ উপার্জন করার পরও কেন ফাহিম বিয়ে করেননি-সে জিজ্ঞাসাও অনেকের। কেউ কেউ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছেন যে, ফাহিমের সঙ্গে বিশেষ কোনও ইস্যুতে হ্যাসপিলের কি শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। এমন প্রশ্নের অবতারণাকারীর অনেকে ভাবছেন যে, মাত্র ৯০ হাজার ডলার চুরি করে ধরা পড়ার কারণে ফাহিমের মতো একজন স্বপ্নবাজ মানুষকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পরিকল্পনা ২১ বছর বয়েসী হ্যাসপিল করতে পারে না।

আবার কেউ কেউ অভিমত পোষণ করেছেন, ফাহিমের মাধ্যমে শেয়ার রাইডিংয়ের দিগন্ত বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হওয়ায় ট্যাক্সি শিল্পে অচলাবস্থার আতঙ্কে বিশেষ একটি মাফিয়া গ্রুপ এমন হত্যাযজ্ঞে হ্যাসপিলকে মদদ দিতে পারে। এদিকেও তদন্ত কর্মকর্তাদের দৃষ্টি থাকা জরুরি।

প্রসঙ্গত, ফাহিমের হত্যার ঘটনা শীর্ষস্থানীয় মার্কিন টিভি ও পত্রিকাগুলো ‘হাই প্রোফাইল হত্যা’ হিসেবে ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশ করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঘাতক শনাক্ত ও গ্রেফতারে খুব একটা কালক্ষেপণের সুযোগ ছিল না।

এদিকে, পরিবারের পক্ষ থেকে করোনার কারণে খুবই সীমিত আকারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রবিবার নামাজে জানাজা শেষে ফাহিমকে দাফন করা হবে পকিস্পিতে। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যে এ জানাজায় শরিক ও দোয়া মাহফিলে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও থাকবে।