অকুতোভয় নারী সাহাবি সফিয়্যাহ (রা.)

প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও অদম্য সাহসিকতার অধিকারী সফিয়্যাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব (রা.)। তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। সেদিন তিনি অভূতপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর জন্য এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, রাসুল (সা.)-কে নিরাপদ দেখতে পেয়ে প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের করুণ মৃত্যুতেও বিচলিত হননি।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা : সফিয়্যাহ (রা.)-এর জন্ম হিজরতের ৫৩ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। তার বাবা ছিলেন রাসুল (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব। নয় বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। আর মা হালাহ বিনতে ওয়াহাব; যিনি রাসুল (সা.)-এর মা আমেনার বোন ছিলেন। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর আপন ফুপি ও খালা। রাসুল (সা.)-এর ‘হাওয়ারি’ বা সঙ্গী জুবাইর ইবনুল আওয়ামের মা ও হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.)-এর সহোদর বোন। বীর-যোদ্ধাদের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠায় তিনিও একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

উহুদের যুদ্ধে কয়েকজনের ভুলের কারণে মুসলিমরা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এমনকি রাসুল (সা.)-ও আহত হন। অল্প কিছু সাহাবি তার পাশে ছিলেন। এমন সময় সফিয়্যাহ (রা.) প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। শত্রুদের প্রতি তীর নিক্ষেপ শুরু করেন। আর পরাজিতদের বলতে থাকেন, ‘রাসুল (সা.) তোমাদের মধ্যে অবস্থানের পরও তোমরা পরাজিত হলে?’ এদিকে রাসুল (সা.) তাকে দেখে ভয় পেলেন। কেননা, ওই সময় হামজা (রা.)-এর দেহ মক্কার কাফেররা বিকৃত করে ফেলেছে। সে দৃশ্য দেখলে সফিয়্যাহ (রা.) সহ্য করতে পারবেন না। তাই সফিয়্যাহর ছেলে জুবাইর বিন আওয়ামকে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে সরিয়ে দাও। তাকে ফিরিয়ে আনো। সে যেন কষ্টদায়ক কোনো কিছু না দেখে।’

যুদ্ধে শহীদদের এক জায়গায় করা হয়েছে। সেখানে যাওয়ার আগেই জুবাইর মাকে পেয়ে গেলেন। কিন্তু কিছু বলার আগেই সফিয়্যাহ জুবাইরের বুকে ধাক্কা দেন। তিনি যেমন অদম্য সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, তেমনি তার শারীরিক শক্তিমত্তাও ছিল অনেক বেশি। জুবাইরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘তুমি এখান থেকে সরে যাও, তোমার কোথাও জায়গা না হোক, তোমার মায়ের মরণ হোক।’ এ কথা শুনে জুবাইর শক্তভাবে দাঁড়ালেন। আর বললেন, ‘মা, আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ এ কথা শুনে সফিয়্যাহ বলল, ‘আমাকে কেন ফিরে যেতে বলেছেন? আমি তো শুনেছি আমার ভাইকে বিকৃত করা হয়েছে। তাতে কী! এটা তো আল্লাহর পথে খুবই সামান্য কিছু। এতে আমরা বিচলিত নই। বরং আমরা আল্লাহর কাছে সওয়াবের প্রত্যাশা করি এবং ধৈর্য ধারণ করি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

খন্দকের যুদ্ধে সফিয়্যা (রা.)-এর সাহসিকতা : খন্দকের যুদ্ধে রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের ও অন্য নারী-শিশুদের খন্দকের পাশে হাসসান বিন সাবেত (রা.)-কে দুর্গে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে সফিয়্যাহ (রা.)-ও ছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল এক ইহুদি দুর্গের পাশে ঘোরাঘুরি করছে। ওই সময় ইহুদিদের বনু কোরায়জার সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়েছে। আর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিও তারা ভঙ্গ করেছে। তাই ওই লোকটি ভীতির কারণ ছিল।

অকুতোভয় নির্ভীক সফিয়্যাহ (রা.) নারী ও শিশুদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলেন। যুদ্ধের পরিখা খননের কাজে রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা ব্যস্ত ছিলেন। নারীদের নিরাপত্তার প্রতি তাদের খুব বেশি মনোযোগ ছিল না। এমন সময় সফিয়্যাহ নিজের অসম সাহসিকতা ও বীরত্বের মাধ্যমে সাধ্যমতো সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ইসলামের সেবা করেন। সিরাতে ইবনে হিশামে বলা হয়, তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসের ওই বীর সেনানী, যিনি সর্বপ্রথম ওই মুশরিককে প্রতিহত করে হত্যা করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২২৮/২)

সন্তানদেরও গড়ে তোলেন নিজ আদর্শে : সফিয়্যাহ নিজেই সাহসী ছিলেন না। বরং নিজের সন্তানকেও সুদক্ষ রণবীর হিসেবে গড়ে তোলেন। ফলে জুবাইর বিন আওয়াম (রা.)-কে ইসলামের জন্য নিবেদিত সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠেন।

মায়ের সুশিক্ষা, অনুশীলন ও অনুপ্রেরণায় জুবাইর (রা.) একসময় রাসুল (সা.)-এর সার্বক্ষণিক সঙ্গীর পরিচিতি লাভ করেন। যুদ্ধের ময়দানেও অদম্য সাহসিকতা ও দক্ষ রণকৌশলী হওয়ায় তিনি ‘ইবনে সফিয়্যাহ’ বা সফিয়্যার সন্তান উপাধি পান।

সফিয়্যাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব (রা.) ২০ হিজরিতে উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তখন তার বয়স ছিল ৭৩ বছর। মদিনার বাকিতে মহীয়ান এ সাহাবিকে দাফন করা হয়।অকুতোভয় নারী সাহাবি সফিয়্যাহ (রা.)