উগ্রতা ঘৃণিত, কোমলতা রহমতপ্রাপ্ত

এক পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম ইসলাম। ইসলাম শান্তি, স্বস্তি ও মানবতার কল্যাণ সুনিশ্চিত করার অনন্য আদর্শ। উগ্রতা, মারামারি, কাটাকাটি, সন্ত্রাস, রাহাজানি কিংবা উচ্ছৃৃঙ্খল আচরণ ইসলাম সমর্থন করে না। অহমিকা, ক্রোধ, হিংসা, কলহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয় ইসলাম। ইসলামের সঙ্গে উগ্রবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম সীমা লঙ্ঘনকারীদের কখনোই সমর্থন করে না।

অথচ আমাদের সমাজে উগ্রতা আজ এক আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে যেখানেই যাই সব জায়গায় আজ উগ্রতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার ছড়াছড়ি। মাহফিলের নামে উগ্রতা, রাজনীতির নামে উগ্রতা, রাষ্ট্র পরিচালনার নামে উগ্রতা, বিরোধিতার নামে উগ্রতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে উগ্রতা, প্রতিশোধের নামে উগ্রতা, মতাদর্শ প্রচারের নামে উগ্রতা- এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে উগ্রতার বিষবৃক্ষ মাথাচাড়া দেয়নি। কিন্তু কেন এ ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা? কেন এ আত্মঘাতী পদক্ষেপ? এ জাতি কি জীবনভর এমন চক্রেই আবদ্ধ থাকবে? কী ধর্মীয়, কী জাগতিক- সব বিষয়ে আমরা যেন অসহিষ্ণু এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। ইতিহাস কী বলে? আমাদের ধর্মীয় তাকিদ কী বলে? বাড়াবাড়ি করে কার কতটুকু লাভ হয়েছে হিসাব করে দেখেছেন কখনো? হিসাব তো দূরের কথা, বরং একজন আরেকজনকে অভিযুক্ত করে সময় পার করছি। হ্যাঁ, বিশ্বাস করি, অতীতেও উগ্রবাদ ছিল; তাতে দাঙ্গাহাঙ্গামা কম হয়নি; বিপর্যয়ও কম আসেনি। কিন্তু এ কথাও তো সত্য- অতীতেও সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা ছিল, সমঝোতাও ছিল এবং তা থেকে দাঙ্গাহাঙ্গামা আর বিপর্যয়ও রোধ করা গেছে। মানুষ স্বস্তি পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বান্দাকে উগ্রতা নয়, নম্রতা গ্রহণ করার আদেশ করে বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বিতর্ক এড়িয়ে বলে ‘সালাম’।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত ৬৩)। রহমানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে এখানে আল্লাহ ‘হাওনানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অভিধানে এর অর্থ স্থির, গাম্ভীর্য, বিনয় ইত্যাদি উল্লেখ করা আছে। রহমানের বান্দারা যখন রাস্তায় চলে তখন তারা গর্বভরে চলে না। অহংকারীর মতো জমিনে পা ফেলে না। অহংকারীর মতো বুকও ফুলিয়ে চলে না। তারা আত্মগর্বে বিভোর, স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে শক্তি দেখানোর চেষ্টা করে না। বরং তাদের চালচলন হয় ভদ্র, মার্জিত ও সৎ স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তির মতো। নম্রতার তাৎপর্য বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর আল্লাহর অনুগ্রহগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কোমলতা ও নম্রতা। কেননা আর দীন প্রচারের জন্য নম্রতাই বেশি প্রয়োজন। রসুল (সা.) যদি কোমল না হয়ে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তাহলে মানুষ হজরতের কাছে না এসে আরও দূরে সরে যেত। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত এই যে আপনি তাদের প্রতি নম্রতা দেখাচ্ছেন। যদি আপনি কঠোর স্বভাবের হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদের ক্ষমা করুন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আর কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরার্মশ করুন। অতঃপর যখন সংকল্প করবেন তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৫৯)।

রুক্ষ ও কর্কশ ভাষা এবং উগ্র আচরণ সব সময় ঘৃণিত। মুসলমানের অন্যতম কাজ হলো তারা শুধু নিজেই ইসলাম মানে না বরং অন্যদেরও ইসলামের প্রতি আহ্বান করা তার দায়িত্ব। আর আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের প্রথম গুণ হতে হবে নরম ভাষায় কথা বলা। আল্লাহ যখন নবী মুসা (আ.)কে ফেরাউনের কাছে পাঠান তখন আল্লাহ বলে দিয়েছেন, অবশ্যই তার সঙ্গে যেন নরম ভাষায় কথা বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তার সঙ্গে নরম কথা বল, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সুরা তহা, আয়াত ৪৪)। অর্থাৎ হে মুসা! তোমার দাওয়াত হবে নরম ভাষায়, যাতে তা তার অন্তরে প্রতিক্রিয়া করে এবং দাওয়াত সফল হয়। এ আয়াতে দাওয়াত প্রদানকারীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ফেরাউন হলো সবচেয়ে বড় দাম্ভিক ও অহংকারী আর মুসা (আ.) হচ্ছেন আল্লাহর পছন্দনীয় নবী। তারপরও ফেরাউনকে নরম ভাষায় সম্বোধন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল, ১২৫)।

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়াালা নিজে কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালোবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা এবং অন্য কোনো আচরণের প্রতি তত অনুগ্রহ করেন না।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ২৫৯৩)। মুসলিম শরিফের অন্য বর্ণনায় এসেছে- একদিন রসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-কে বললেন, ‘হে আয়শা! কোমলতাকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কেননা যে জিনিসের মধ্যে কোমলতা থাকে, তা সুন্দর হয়। আর যে জিনিসে কোমলতা থাকে না, তা অসুন্দর হয়ে পড়ে।’ (মেশকাত, হাদিস নম্বর ৫০৬৮)।

Scroll to Top