ফিলিস্তিনী আরবদের হটিয়ে যেভাবে জন্ম হয়েছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের

১৯৩০ এর দশকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের গাজায় বসবাস শুরু করে। এরপর ইহুদিরা দলে দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারা ভেবেছিল দ্রুত সমস্যার সমাধান হলে তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।

কিন্তু ইসরাইল তাদের আর কখনই বাড়ি ফিরতে দেয়নি। ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ ১০ বছর আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনদের কেন এই দশা হলো সেজন্য তাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত।

পেরেজ বলেন, অধিকাংশ জমি ফিলিস্তিনদের হাতেই থাকতো। তাদের একটি আলাদা রাষ্ট্র হতো। কিন্তু তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৪৭ সালে তারা ভুল করেছে। আমরা কোনও ভুল করিনি। তাদের ভুলের জন্য আমরা কেন ক্ষমা চাইবো?

১৮৯৭ সাল থেকেই একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিল ইহুদিরা। ১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখনই ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেন।

ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। তৎকালীন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে চিঠি ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে একটি রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটেনের সহায়তার কথা জানান তিনি।

যদিও রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সে জায়গায় বসবাস করতো। ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সেটি তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরও তরান্বিত করেছে। ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন।

ইতোমধ্যে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফিলিস্তিনি আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা।

কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ফিলিস্তিনদের উপর ব্রিটিশ সৈন্যরা এত কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়েছিল যে আরব সমাজে ভাঙন তৈরি হয়েছিল। ইহুদীরা তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল। ব্রিটেনের সহায়তায় সে অনুযায়ী তারা কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যার পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচেছিলেন তাদের জন্য জন্য কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়।

আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এত বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে।

এ সময় ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার হাজার ইহুদিদের বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

পরে ব্রিটেন জাতিসংঘের কাছে যায়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিল আরবদের দ্বিগুণ।

আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অবশেষে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেলো। কিন্তু আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।

ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো তখন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তাদের গোপন অস্ত্র কারখানাও ছিল। কিন্তু ইহুদিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। এর বিপরীতে আরবদের কোনও নেতৃত্ব ছিল না। ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদিরা।

সবার দৃষ্টি ছিল জেরুজালেম শহরের দিকে। মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের জন্য পবিত্র এ জায়গা। জাতিসংঘ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল সেখানে জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আরব বা ইহুদি কোনও পক্ষই সেটি মেনে নেয়নি। ফলে জেরুজালেম শহরের নিয়ন্ত্রণের জন্য দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

জেরুজালেমে বসবাসরত ইহুদিদের অবরুদ্ধ করে রেখেছিল আরবরা। অন্য জায়গার সাথে জেরুজালেমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ইহুদিরা আরবদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। অনেক বিশ্লেষক বলেন, তখন ইহুদীরা আরবদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিল।

আরবদের মধ্যে কোনও সমন্বয় ছিল না এই সুযোগে ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়। আরব দেশগুলোও ফিলিস্তিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। এরপর ইহুদিরা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বহু ফিলিস্তিনি আরব তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসঙ্গে পাঁচটি আরব দেশ ইসরাইলকে আক্রমণ করে।

যেসব দেশ একযোগে ইসরাইলকে আক্রমণ করেছিল তারা হচ্ছে – মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরাইলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার।

কিন্তু আরব দেশগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় ছিলনা। তাছাড়া আরব নেতৃত্ব একে অপরকে বিশ্বাস করতো না। জেরুজালেম দখলের জন্য আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই। ইহুদিরা ভাবছিল জেরুজালেম ছাড়া ইহুদি রাষ্ট্রের কোন অর্থ নেই। অন্যদিকে মুসলমানদের জন্যও জেরুজালেম পবিত্র জায়গা।

তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরাইলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

যুদ্ধবিরতির সময় দুইপক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু ইসরাইল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরাইলের হাতে। যুদ্ধ বিরতী শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাইলি বাহিনী। একর পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা।

তেল আবিব এবং জেরুজালেমের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরেকটি যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে সে সংঘাত থামে। ইসরাইলী বাহিনী বুঝতে পরে তারা স্বাধীনতা লাভ করছে ঠিকই কিন্তু লড়াই এখনো থামেনি।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ছয় হাজার ইহুদি নিহত হয়েছিল। ইহুদিরা মনে করে তারা যদি সে যুদ্ধে পরাজিত হতো তাহলে আরবরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতো। তবে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে ইসরাইল। তারা সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়।

সংবাদ সূত্রঃ বিবিসি

Leave a Comment