রোহিঙ্গা সঙ্কট: শক্তিধররা কে কোন অবস্থানে?

গেল ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় সেনা অভিযানের মুখে সীমান্ত পেরিয়ে ফের বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। এ সংখ্যা এখন ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারতের প্রায় ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢুকে গেছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পাশে মানবিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। তাদের আশ্রয়, আবাসনসহ খাদ্য নিরাপত্তা দেয়ারও ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও অসহায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সহায়তা আসছে বাইরের দেশগুলো থেকেও।

এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ জানিয়েছে, আরও প্রায় লাখ পাঁচেকের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিতে রাখাইনে অপেক্ষমান আছে। এত বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ সময় খাদ্য ও আবাসন দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

বিপরীতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সেদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে রাখাইনে বর্বরোচিত গণহত্যা বন্ধে দেশটির সেনা সরকার ও গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি’র প্রতি জোর আহ্বান জাতিয়েছে বাংলাদেশসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।

তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিপরীতমুখি অবস্থানে আছে বিভিন্ন দেশ। তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার কথা ভেবেই সুবিধাজনক অবস্থানের সন্ধান করে নিচ্ছে দেশগুলো। তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পর্যায় থেকে বারবার একটি কথা বলা হচ্ছে- রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে হবে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত ও চীনকে। যদিও ভোগলিক স্বার্থ বিবেচনায় এখনও বিপরীত অবস্থানে রয়েছে দেশ দুটি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন দেশ কি অবস্থানে তা নিচে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশ

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷

ভারত

দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷

চীন

মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷

রাশিয়া

চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস৷ মুখপাত্র সারাহ হুকাবে বলেছেন, ‘রাখাইনে জঙ্গি হামলাসহ উভয়পক্ষের অভিযান নিয়ে ‘গভীর অস্বস্তিতে’ আছে যুক্তরাষ্ট্র৷’

তুরস্ক

রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)

ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷

জাতিসংঘ (ইউএন)

জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয়, তাদের আশ্রয় দেয়ায় ও তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখায় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানি মিয়ানমারের বেশ কিছু খাতে সহয়তা বন্ধ ঘোষণা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠাচ্ছে তুরস্ক-মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ জনগণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে উদারতা ও মানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা।