মীম কোথাও যাবে না, নানা-নানির কাছে থেকে ওখানেই পড়াশুনা করবে

\”আমি কোথাও যাবো না। আমি নানা-নানির কাছে থাকব। এখানেই পড়াশুনা করবো।\” পদ্মায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় একইসঙ্গে বাবা, মা ও দুই বোন হারানো খুলনার তেরখাদা উপজেলার ৯ বছরের শিশু মীম মলিন মুখে এ কথা গুলো বলে।

তেরখাদা উপজেলার পানতিতা গ্রামে নানা বাড়িতে অবস্থানরত মীম গত বৃহস্পতিবার (৬ মে) দুপুরে এসব কথা বলে। আব্দুস সবুর মিনা মীমের নানা, তিনি পেশায় একজন কৃষক।

মাদারীপুর জেলার শিবচর নামক একটি স্থানে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার পারখালী গ্রামের একই পরিবারের চারজন নিহত হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় ৯ বছর বয়সের শিশু মীম। দুর্ঘটনায় পিতা মনির হোসেন, মাতা হেনা বেগম ও মীমের ছোট দুটি বোন সুমি ও রুমি মারা যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মীম পদ্মায় তীরে এসে ওঠে। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬ জন। অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান ৫ জন। তার মধ্যে একজন মীম।

একসঙ্গে বাবা, মা আর দুই বোনকে হারানোর পর থেকে নানির কোলই যেন হয়ে উঠেছে মীমের একমাত্র ভরসাস্থল। এদিকে এ ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহসান হাবিব ভূঁইয়াসহ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মীমের সব দায়িত্ব নেওয়ার। আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন অনেকে।

মীমকে কারও কাছে দেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মীমের নানা আব্দুস সবুর মিনা বলেন, \”আমারতো সব হারায়ে গেছে। ও শুধু একমাত্র আছে। ওকে আমার কাছে রাখার ইচ্ছা। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। ওকে কাউকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। সেই মনমানসিকতাও নেই। মীমকে নিয়ে জীবনের বাকি সময়টা পার করে দিতে চাই। ওই এখন আমাদের সবাই বেঁচে থাকার অবলম্বন। তবে ওকে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে করতে পারবে।\”

মীমের কান্নাকাটি কমেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, \”আগের চেয়ে একটু কমেছে। বর্তমানে আমার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে মীমের সময় কাটছে। আমাদের ঘরের সঙ্গে একটি মাদ্রাসা আছে সেখানে মীম লেখাপড়া করবে।\” মীমের দাদা ও নানার পরিবার একসঙ্গে পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। মীমের চাচারা বলেন, নানার বাড়ি থাকলেও চাচাদের পক্ষ থেকে সার্বিক দেখাশুনা করা হবে।

গত মঙ্গলবার (৪ মে) বাবা, মা ও দুই বোনের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে নিহত মনিরের মায়ের পাশে সারিবদ্ধ করে দাফন হয় দাদা বাড়ি উপজেলার পারোখালি গ্রামে। এরপর মীম নানা-নানীর সঙ্গে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে ওই দিন বিকেলে পানতিতা গ্রামে চলে যায়। স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, যার কাছে মীম থাকার আগ্রহ প্রকাশ করবে তার কাছেই থাকবে। সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে তাকে।

তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, \”উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে মীমের জন্য ১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া মীমের বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা তার ভরণপোষণ দেবো বলে এলাকাবাসীর কাছে ওয়াদা দিয়েছি।\”

এদিকে গত বৃহস্পতিবার (৬ মে) সকাল ১০টায় পরিবার হারা মীমের নানা বাড়ি উপজেলার পানতিতা এলাকায় গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। পরিবার হারা মীমের হাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুলে দেন নগদ ১০ হাজার টাকা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, \”জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সদয় নির্দেশনায় মীমের খোঁজ খবর নিয়েছি এবং পরবর্তীতে সব ধরনের সহযোগিতার জন্য জেলা প্রশাসক নির্দেশনা রয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুস্মিতা সাহাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

উল্লেখ্য, মনির শিকদার ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে থাকতেন মিরপুরে। গত রোববার রাত ৮টায় খুলনার তেরখাদার বাড়িতে মনির শিকদারের মা মারা যান। সোমবার সেহরি খেয়ে মায়ের মরদেহ দেখতে তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়েই খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মাদারীপুরের শিবচরে পুরাতন কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট এলাকায় পদ্মায় স্পিডবোটের সঙ্গে বালুভর্তি বাল্কহেডের সংঘর্ষে নিহত হন তেরখাদার পারোখালী এলাকার মনির শিকদার, তার স্ত্রী হেনা বেগম, মেয়ে সুমি আক্তার (৭), রুমি আক্তার (৪)। প্রাণে বেঁচে যায় শুধু তাদের ৯ বছর বয়সী মেয়ে মীম আক্তার। ৫ সদস্যের পরিবারটির একমাত্র সন্তান হিসেবে জীবিত আছে বড় মেয়ে মীম।

Scroll to Top