মিয়ানমারে যে কারণে সেনা অভ্যুত্থান

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আবারও ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী। সে সঙ্গে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনী সমর্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক জেনারেল মিন্ট সোয়ে। ক্ষমতা গ্রহণের পরই এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে দেশটির রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিসহ দলের শীর্ষ নেতাদের আটক করে সেনাবাহিনী।

গত বছরের ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বড় জয় পায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৩২২টি আসন, যদিও এনএলডি ৩৪৬টি পায়। এদিন নবনির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিজেদের পক্ষে নিল।

অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরেই উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর। বার্তা সংস্থা এএফপি হঠাৎ এই সেনা অভ্যুত্থানের কারণ এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে।

গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল দ্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি জয়ী হয়। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই। ২০১৭ সালে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণহত্যা নিয়ে সু চি কার্যত দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষেই ছিলেন। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি।

গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ২০১৫ সালের তুলনায়ও সে বছর সু চির দল বেশি ভোটে জয়ী হয়। এরপর সু চি ক্ষমতায় আসেন। এই নির্বাচন নিয়ে সেনাবাহিনীর অভিযোগ, ভোটে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, ভোটে কারচুপির এক কোটির বেশি ঘটনার প্রমাণ রয়েছে তাদের কাছে। যাচাই–বাছাইয়ের জন্য সেনাবাহিনী সরকার পরিচালিত নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটার তালিকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এক বক্তব্যে মিয়ানমারের সংবিধান বাতিল করার হুঁশিয়ারি দেন। এরপরই উত্তেজনা চরমে ওঠে। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায়, রাজধানী নেপিডো ও অন্যান্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। নির্বাচনের ফল নিয়ে সেনা–সমর্থকরা বিক্ষোভ করেন। এসবেরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।

সেনাবাহিনী মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। আগামী এক বছর ক্ষমতায় থাকার ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল মিন্ট সোয়ে ছিলেন মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে মিন্ট সোয়ের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি পাঠ করা হয়। তাতে মিন্ট সোয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হালিংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলো। মিয়ানমারে আবার সেনা শাসন ফিরে এল।

কী হবে মিয়ানমারের সংবিধানের!
২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানে দেশটির সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর হাতে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসনের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। তাই যে কোনো পরিবর্তনের জন্য সামরিক আইন প্রণেতাদের সমর্থন প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক খিন জ উইন জানান, ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই সু চি ও তার সরকার সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে খুব সামান্যই সফলতা এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সো মিন্ত অং বলেন, আইনের ফাঁকফোকরের কথা সেনাবাহিনী আগে ভাবেনি। সেনাবাহিনী মনে করছে, এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কমেছে।

মিয়ানমারে সেনা শাসনের ইতিহাস
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই মিয়ানমারে বেশির ভাগ সময় সেনা শাসন চলেছে । ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল নি উইন। পরের ২৬ বছর সরকার পরিচালনা করেন নি উইন। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।