অ্যাকচুয়ালি বাবার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই: এভ্রিল

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে চট্টগ্রামের মেয়ে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে। আগামী নভেম্বরে চীনে অনুষ্ঠেয় ৬৭তম ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। তবে বিচারকদের মধ্য থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের রায় পাল্টে আয়োজকদের পছন্দে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে এভ্রিলকে। এরপর থেকে এভ্রিলকে ঘিরে প্রশ্ন তৈরি হয়। গ্লিটজ’কে তেমনই কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি।

গ্লিটজ: ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতায় বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অনুভূতি কেমন?

এভ্রিল: ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন অনেক খুশি ছিলাম। কিন্তু পরদিন থেকে আমি বাংলাদেশের মেইন ইস্যু হয়ে দাঁড়াই! সেটা যে কোনো একটা কারণে। অনেক ইতিবাচক কথা শুনছি, অনেক নেতিবাচক কথা শুনছি। তবে নেতিবাচক কথাগুলো শুনে আমি খুব আপসেট, আবার খুব বেশি আপসেটও না। কারণ আমি নিজের যোগ্যতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এমনিই ওরা (আয়োজক) আমাকে মুকুট দেয়নি, জাজ করেই দিয়েছে। তবে এটা নিয়ে মানুষ অনেক কথা বলছে। এর বেশকিছু কারণ থাকতে পারে। অনেকে হয়ত তার পছন্দের মানুষকে বিজয়ী হতে দেখেনি। অথবা হয়ত যাকে চিন্তা করেনি সেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যোগ্যতার কারণে। হয়ত এটা সবাই সহজভাবে নিতে পারেনি। আবার এটাও হতে পারে, প্রথমে একজনের নাম ঘোষণা করার সময় ভুলে আরেকজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। আবার পরে আরেকজনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে যোগ্য তাকেই দেওয়া হয়েছে আসলে।

গ্লিটজ: কিন্তু বিচারকরা অভিযোগ তুলেছেন, তাদের রায় পাল্টে আয়োজকরা চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

এভ্রিল: খবরে বিচারকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরটা দিন আমাকে। সেই বিচারক যদি এতটাই সৎ হয়ে থাকবেন, সে তাহলে তার নাম কেন গোপন করবে?

গ্লিটজ: বিচারক শম্পা রেজা বিডিনিউজকে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল তার মনোনীত দুজনের তালিকাতেই ছিলেন না।

এভ্রিল: যদি বিচারকদের কথা মূল্যায়ন করা না হত তাহলে এই প্রতিযোগিতায় বিচারকদের রাখার কোনো মানেই হয় না। বিচারকরা জাজ করেই আমাকে চ্যাম্পিয়ন করেছে। এটাই শেষ। আমার আর কিছু বলার নেই।

গ্লিটজ: সমালোচনাগুলোকে কীভাবে দেখছেন?

এভ্রিল: আমার মধ্যে এখন জেদ চেপেছে। কিছু কিছু মানুষ আমাকে নিচে টেনে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি ফাইট করছি। নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করব। আমি এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছি।

আমার মধ্যে যে জেদটা কাজ করছে সেটা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখাব। সাকিব আল হাসান অনেক বড় ক্রিকেট প্লেয়ার। তার নামেও অনেকে অনেক কিছু বলে। কিন্তু ভালো পারফর্ম করলে সব ভুলে যায়। আমিও ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্মে গিয়ে কিছু একটা করব।। বাংলাদেশকে দেখিয়ে দেব। আমি সেটার জবাব দিয়ে দেব।

আর নেতিবাচক বিষয়গুলো নেতিবাচকভাবে নিচ্ছি না। আমার অতটুকু টাইমও নেই যে, এগুলো নিয়ে চিন্তা করব। এটা বলব, আমার যোগ্যতা ছিল বলেই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কিন্তু অনেক মানুষ বলছে, আমি এটার যোগ্য না। এসব নিয়ে কিছু বলার নাই।

আমার কথা হলো, আমি যেহেতু হয়েই গেছি আর তো কিছু করার নাই। এখন আমাকে আপনাদের সাপোর্ট দেওয়া উচিত। আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিন। নিজেকে আরো ইমপ্রুভ করে বাংলাদেশের মান-সম্মানটা যেন রাখতে পারি। বাংলাদেশের মানুষের উচিত আমাকে ইন্সপায়ার করা। আমাকে নিয়ে সমালোচনা করা উচিত না।

গ্লিটজ: চীন যাওয়ার আগে কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

এভ্রিল: ১৫ দিন পর চায়না চলে যাচ্ছি। আমার বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। যেমন, খুব দ্রুত ইংরেজি বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলি। আর বাংলা শুদ্ধ হয় না। একটা মানুষ তো সবকিছু নিয়ে পরিপূর্ণভাবে জন্মায় না। ইংরেজির কিছু কোর্স শুরু করেছি। আর বাংলায় কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলছি। কাল থেকেই ক্লাস শুরু করব। বিবি রাসেল ম্যাম আমাকে বলেছেন, আমার হাসি, হাঁটা, ক্যাটওয়াক-সব কিছুই পারফেক্ট। আমার নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটুকু আছে যে, আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে ফাইট করতে পারব। শুধু আমার উচ্চারণটা যদি ঠিক করে ফেলতে পারি, ভালো করব।

গ্লিটজ: ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’-এ দেড় মাসের জার্নিটা কেমন ছিল আপনার?

এভ্রিল: আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করছিলেন, আপনি কাকে প্রতিযোগী মনে করেন? অথবা এর জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করেন কি না? আমি তখনই বলেছিলাম, আমি শতভাগ আত্মবিশ্বাসী। কারণ আমি চিন্তাই করিনি, আমি হব না। আমি সবসময়ই চিন্তা করেছি আমি হব (চ্যাম্পিয়ন)। আমি নিজেই নিজের প্রতিযোগী। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমি নাচতে পারতাম না। দিন-রাত নাচ শিখছি। এগুলো তো একদিনে হয়নি। দেড়টা মাস আমাকে কষ্ট করতে হয়েছে। আমি নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে এতদূর এসেছি। এটার প্রতিদান শুধুমাত্র আমার মুকুটটা। আর কিছু না।

এমনি এমনি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাইনি। জাজমেন্ট শুধুমাত্র একঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায় না। ওরা (বিচারক) আমাদের দেড় মাস সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। আমরা কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলছি, কীভাবে খাবার খাচ্ছি, কী ধরনের আচরণ করছি-সবকিছু দিয়েই আমাদের বিচার করেছেন। যে সব দিক দিয়েই পরিপূর্ণ তাকেই বিজয়ী করা হয়েছে।

গ্লিটজ: ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতা নিয়ে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?

এভ্রিল: বিশ্বমঞ্চে গিয়ে আমাকে পারতেই হবে। আমি যেহেতু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি, আমাকে পারতেই হবে। দেশের মান-সম্মান আমাকে রাখতেই হবে। এতগুলো মানুষ আমাকে এত কথা শুনিয়েছে, সবাইকে জবাব দিতে হবে। এটা আমার নিজের কাছে নিজের কমিটমেন্ট। ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ চ্যাম্পিয়ন হয়েই সমালোচনার জবাব দিব।

গ্লিটজ: এতদূর আসার পেছনে আপনার পরিবারের ভূমিকা কেমন ছিল?

এভ্রিল: মা আমাকে নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখতেন। আমার মা আমার সুপারউইমেন। যেখানেই বাধা পেয়েছি মা উৎসাহ দিয়েছেন। এখন যেমন অনেকে আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন তখন মা বলেছে, তুমি ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ মুকুটটা ছিনিয়ে নিয়ে এসে সবাইকে দেখিয়ে দাও, তোমাকে তোমার যোগ্যতায় চ্যাম্পিয়ন করা হয়েছে।

গ্লিটজ: আপনার বিয়ে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে অর্ন্তজালে। বিয়ে করেছেন কি না?

এভ্রিল: আমার বয়স যখন ষোল, তখন বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমাদের চিটাগাংয়ে একটা নিয়ম আছে, মেয়েরা একটু বেশি সুন্দরী হলে সবাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। বিয়ের জন্য ফ্যামিলিকে খুব বেশি ‘প্যারা’ দেয়। এটা চিটাগাংয়ের স্বাভাবিক ঘটনা।

তো আমাদের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটে। ছোটবেলায় খুব সুন্দরী ছিলাম আমরা দুই বোন। প্রতিবেশীরা বাবাকে বলত, আপনাদের মেয়েকে বিয়ে দেন। এগুলোতে প্রভাবিত হয়ে বাবা রাজি হয়ে যান। আমাকে বিয়ের চাপ দেন। আমি খুব বেশি দুরন্ত ছিলাম। আমি নিজের মতো থাকতে চাইতাম। অল্প বয়সে বিয়ের প্যারার মধ্যে ঢুকে যেতে চাইনি। বাবার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ওখান (চট্টগ্রাম) থেকে চলে আসি। আমি স্টাডি করব, নিজের ক্যারিয়ার গড়ব। এখন অ্যাকচুয়ালি বাবার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ফ্যামিলির বাকিরা আমাকে সাপোর্ট দেই। আমি বেঁচে আছি ফ্যামিলির কারণে।

গ্লিটজ: এর আগে সংবাদে এসেছিলেন, বাইক-চালক পরিচয়ে। কবে থেকে বাইক চালানো শুরু করেন?

এভ্রিল: ছয়বছর আগে শুরু করি। এটা আমার শখে পরিণত হয়েছে। এখনও আমার বাইকটা চালাই। বুড়ো হলেও চালাবো।

গ্লিটজ: আপনাকে ‘মাফিয়া গার্ল’ কেন বলা হয়?

এভ্রিল: বন্ধুরা এই নামে ডাকে। আমি মাফিয়াদের মতো আচরণ করতাম। মাফিয়া বলতে আন্ডারগ্রাউন্ডের মাফিয়া না। আমি যখনই দেখতাম, কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে টিজ করছে তখন আমি ছেলেটাকে পিটাতাম। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, অনেক ছেলেদের আমি মেরেছি। আমাকে অনেকবার ছিনতাইকারীরা ধরেছিল। আমি ওদেরও পিটিয়েছি। আমাকে ‘মাফিয়া গার্ল’ ডাকা হয় শুধুমাত্র প্রতিবাদী চরিত্রের জন্য। আর কোনো কিছুই না। সবাই জানে মাফিয়ারা অনেক কিছুই করতে পারে চাইলে। আমার মনে হয়, বন্ধুরা সেই কারণেই আমাকে এ নামে ডাকে।

গ্লিটজ: আপনার সামনের পরিকল্পনা কী?

এভ্রিল: আমার বোনের মেয়ে গতবছরে মারা গেছে। একটা ভাইরাসের কারণে বিশ মিনিটের মধ্যে দুইবার বমি করে আমার হাতের উপর মারা গেছে। আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি। বাংলাদেশের অনেক বাচ্চারা ভিক্ষা করে। যখন দেখি, আমার ফেলে দেওয়া খাবারটি ওরা তুলে খায়। তখন অনেক বেশি খারাপ লাগে। আমার ভাগ্নিও তো ওদের বয়সী ছিল। ওকে বাঁচাতে পারিনি। আমি ভাবি, ওদের (পথশিশু) জন্য কিছু করতে পারি তাহলে আমার ভাগ্নির আত্মা শান্তি পাবে। আমি চাই, যত বড়ই হই না কেন, বাংলাদেশ ও পুরো বিশ্বের অসহায় বাচ্চাদের খাবার ও আবাসন নিয়ে চিন্তা করব। ওদের পাশে দাঁড়াব। সূত্র: বিডিনিউজ

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, ০২ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/সাদ

Scroll to Top