করোনাঃ যারা অক্সিজেন সিলিন্ডারের বাজার ‘অস্থির’ করছে

করোনার মহামারী পরিস্থিতিকে পুঁজি করে চট্টগ্রামে লাগামহীন অক্সিজেন সিলিন্ডারের বাজার। চাহিদা বাড়ায় কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়েও মূমূর্ষ রোগীদের জন্য মিলছে না মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আগে একটি মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় মিললেও এখন সেই সিলিন্ডার কিনতে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামে অক্সিজেন সিলিন্ডারের বাজারে হঠাৎ এই অস্থিরতার পেছনে ৪টি প্রতিষ্ঠানের কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বড় অংকের জরিমানাও করা হয়েছে এইসব প্রতিষ্ঠানের মালিককে।

এই চার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- নগরের কাজীর দেউড়ির হাসান ট্রেডার্স, সদরঘাটের ব্রাদার্স প্রকৌশলী ওয়ার্কস, চকবাজারের বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ এবং কর্ণফুলীর জিলানী অক্সিজেন লিমিটেড।

এইসব প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে দেশের সবচেয়ে বড় মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সাগরিকার ‘লিন্ডে বাংলাদেশের’ ডিলার দাবি করলেও এর সত্যতা খুঁজে পাননি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

বরং বুধবার দুপুরে লিন্ডে বাংলাদেশের কারখানায় অভিযান চালিয়ে এই চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, একটি ১ হাজার ৪০০ লিটারের মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার লিন্ডে বাংলাদেশ ভ্যাটসহ বুধবার ১৬ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করেছে। প্রতি অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফুয়েলিং করেছে ১২৮ টাকায়।

‘কিন্তু বাজারে এই রকম অক্সিজেন সিলিন্ডার ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি এবং প্রতি অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফুয়েলিং খরচ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং ক্রেতার মাঝখানে মধ্যসত্বভোগী হয়ে কেউ বাকি টাকাটা হাতিয়ে নিচ্ছে।’

মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত মধ্যসত্বভোগী হয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছি আমরা। হাসান ট্রেডার্স, ব্রাদার্স প্রকৌশলী ওয়ার্কস, বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ এবং জিলানী অক্সিজেন লিমিটেডে অভিযান পরিচালনার সময় অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা-বেচার কোনো রশিদ দেখাতে পারেনি তারা।

‘এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ কয়েক বছর আগে লিন্ডে বাংলাদেশের হয়ে হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করতো। তবে টেম্পারিংয়ের দায়ে তাদের অব্যাহতি দিয়ে কালো তালিকাভূক্ত করে লিন্ডে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। বাকি তিন প্রতিষ্ঠানও নিজেদের প্যাডে লিন্ডে বাংলাদেশের ডিলার দাবি করলেও এর সত্যতা মেলেনি।’

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লিন্ডে বাংলাদেশ ছাড়াও দেশে আরও দুইটি প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন করে।

কালুরঘাটের স্পেকট্রাম অক্সিজেন লিমিটেড এবং নারায়ণগঞ্জের ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড নামের এই দুই প্রতিষ্ঠানেরও চট্টগ্রামে কোনো ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর নেই। তারা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট প্রস্তুত করে দেয়। পরবর্তীতে সেখানে প্লান্টে অক্সিজেন সরবরাহ করে।

এছাড়া হাসপাতালের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে ব্যক্তি পর্যায়ে বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রোগীর জন্য ১ হাজার ৪০০ লিটার অক্সিজেন ধারণক্ষমতা সিলিন্ডার বিক্রি করে। যা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।

এই কারণে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই সময়ে বিক্রি হওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে তৈরি হওয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডার মেডিক্যাল গ্রেড বলে বিক্রি এবং লিন্ডে, স্পেকট্রাম ও ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের পুরনো অক্সিজেন সিলিন্ডারে রিফুয়েলিং করে করোনার এই সময়ে চড়া দামে বিক্রি করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

এই বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, যেহেতু মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি এবং বিপণন করা তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনো ডিলার নেই, তাই বাজারে বিক্রি হওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

আমরা চট্টগ্রাম ভিত্তিক বেশ কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এসব পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডারে ভরে মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন হিসেবে বাজারে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছেন বলে জানতে পেরেছি। শিগগির সেখানেও অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা জানান, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট নেই। লিন্ডে বাংলাদেশের বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিনিধিরা আমাদের জানিয়েছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। চাহিদা থাকায় ২০ জুনের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে আরও ৪ হাজার মেডিক্যাল গ্রেড সিলিন্ডার আমদানি করে সাপ্লাই চেইনে যুক্ত করবেন তারা।