সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই সাক্ষ্য নেন। এদিন শুরুতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বক্তব্য দেন। এরপর সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর এই মামলার প্রথম সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন আন্দোলনে চোখ, মুখ, নাক ও চোয়াল হারানো খোকন চন্দ্র বর্মণ। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আইনজীবী তাকে জেরা করেন। আজ সোমবার ফের এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে।
সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘খুব কাছ থেকে পুলিশ টার্গেট করে মাথায় গুলি করে; কিন্তু সেটা আমার মুখে লাগে। আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল, বাঁচার অবস্থা ছিল না।’ এ সময় সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ মাস্ক খুলে মুখ দেখান। দেখা যায়, তার বাঁ চোখ, নাক ও মুখ পুরোটাই বিকৃত হয়ে গেছে। খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘যারা হাজার হাজার মানুষকে মেরেছিল, তাদের জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান—তারা দায়ী এবং আমি তাদের বিচার চাই।’
এর আগে শুরুতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার। কোনো স্বৈরাচারকে মিথ্যার ওপর পিএইচডি করতে হলে তাকে শেখ হাসিনার কাছে শিখতে হবে। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসককে নিয়ে যদি কোনো সমিতি করা হয়, শেখ হাসিনা হবেন তার সভাপতি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমরা স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
হিটলারসহ বিশ্বের সব স্বৈরাশাসকের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ব্রিটেনে গণহত্যার দায়ে, ক্যাথলিকদের নির্বিচারে হত্যার দায়ে অলিভার ক্রমওয়েলকে মৃত্যুর পর কবর থেকে তুলে এনে পচা-গলা লাশকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে জনসমক্ষে বিচার করা হয়েছিল। পরে তার মাথার ভেতরে রড ঢুকিয়ে ব্রিটেনের ওয়েস্ট মিনস্টারে ২০ বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনশ বছর পর তার সেই লাশ সমাহিত করা হয়। আগামীর ব্রিটেনে কেউ যাতে তার মানুষকে এমনভাবে গণহত্যার সাহস আর কেউ না দেখায়, সেজন্য এমন বিচার করেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘যে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে, তাতে আমরা হয়তো অলিভার ক্রমওয়েলের মতো এরকম নির্মম নিষ্ঠুরভাবে লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ফাঁসি দেব, এতটা অমানবিক আমরা নই। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আর এই শাস্তি চাই আইনি পরিকাঠামোয়। যে উপাদান প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনবে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এবং সাক্ষ্য শুনে আগামী প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে, আগামী প্রজন্মকে বসবাসের জন্য, আগামীর বাংলাদেশ গড়ার জন্য ন্যায়বিচার করবেন—সেই দাবি জানাই।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই মামলায় বিচার প্রক্রিয়ায় বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশের মাটিতে গুম-খুনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যে রাজনীতি করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গুম-খুন, রাতের ভোট, চাঁদাবাজি, বিদেশে লাখ লাখ ডলার-পাউন্ড পাচার করে বেগমপাড়ায় বাড়ি বানানো। এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। আর এই আন্দোলন দমানোর জন্য প্রায় ২ হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছে, ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। তারপরও তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এমন একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে খুনের রাজনীতি আর থাকবে না।’
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখা। তিনি ছিলেন এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু বা নিউক্লিয়াস। অন্য আসামিরা তার অধীনে থেকে বুঝতেন যে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ওপরই তাদের নিরাপত্তা ও পুরস্কার নির্ভর করছে।’ সূচনা বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে দুটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়, যা ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত-আহতদের নিয়ে। এ সময় ভিডিও দেখে এজলাসে থাকা আইনজীবী, সাংবাদিকদের চোখে পানি টলমল করতে দেখা যায়। নিহত-আহতদের ভিডিও প্রদর্শনীর সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেকের চোখের কোণে জল আসতে দেখা যায়। কেউ বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। স্থির থাকতে পারেননি আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তার চোখের কোণেও পানি দেখা যায়। ভিডিও প্রদর্শনীর সময় মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে চারপাশ। মামলার বিচারের সূচনা বক্তব্য বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে সাক্ষীর নাম-ছবি প্রকাশ না করার জন্য সাক্ষ্য গ্রহণের অংশ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়নি।







